গণবাণী ডট কম:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক উচ্চ অ্যান্থসায়ানিন সমৃদ্ধ লবণ সহিষ্ণু শিমের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. গোলাম রসুলের নেতৃত্বে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা পূর্বক শিমের নতুন জাতটি উদ্ভাবন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ গোলাম রসুলের নেতৃত্বে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা পূর্বক সীমের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। সম্প্রতি জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত উক্ত নতুন বিইউ সীম-৭ জাতটি লবণ সহনশীল ও উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় বাংলাদেশের বিস্তৃত দক্ষিণাঞ্চলে শীত মৌসুমে পতিত থাকা জমির সুষ্ঠ ব্যবহার এবং সেই সাথে অধিক পরিমাণ সবজী উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হবে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করছেন।
গবেষক দলের প্রধান প্রফেসর ড. মো. গোলাম রসুল জানান, সীম country bean: Lablab purpureus L) বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় শীতকালীন সবজী। গ্রাম বাংলার প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় এ ফসলটি আদিকাল থেকে আবাদ হয়ে আসছে। অধুনা সীমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশের বহু স্থানে মাঠে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সীম চাষ হচ্ছে। আবাদের বিস্তৃতি ও পুষ্টিমানের বিবেচনায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ ছাড়াও শরীরের মাংস গঠন ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন সীম থেকে পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম কচি সীম থেকে ৪-৫ গ্রাম প্রোটিন, ১০ গ্রাম শ্বেতসার, ০১ গ্রাম স্নেহ, ২ গ্রাম অম্ল ও কিছু পরিমাণ বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ২০ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫০ টন সীম উৎপাদিত হচ্ছে (বিবিএস, ২০২০)। বিশ্বের তুলনায় প্রতি হেক্টরে ১০ টন বাংলাদেশে প্রচলিত জাত সমুহের সীমের ফলন যথেষ্ট কম প্রতি হেক্টরে ৩ থেকে ৬ টন।
অধিকন্ত দেশের প্রায় সমস্ত জাত গুলি মৌসুমের একই সময়ে ফলন দেয় এবং বেশীর ভাগ চাষী একই সময়ে তাদের সীম বাজারে নিয়ে আসে, ফল স্বরুপ সীমের বাজার মূল্য হ্রাস পায়। তাছাড়া খরা, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, পোকামাকড় (এফিড) বা রোগ বালাইয়ের আক্রমণে উৎপাদন কমে যায়। বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৩৭% উপকূলীয় এলাকা। ঐ এলাকাতে চাষ উপযোগী সবজী তথা সীমের অনুমোদিত উফশী তেমন জাত নাই। এমতাবস্থায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা, টেকসই খাদ্য উৎপাদন বজায় রাখা এবং খরা, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততার ঋণাত্বক প্রভাব প্রতিরোধ সহ বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকায় চাষযোগ্য নতুন জাত( wider adaptive variety) উদ্ভাবনই সর্বোত্তম ও বিকল্প উপায়।
নতুন উদ্ভাবিত জাতটির বৈশিষ্ট্য সমূহ :
ক) উচ্চ ফলনশীলতা: গাছপ্রতি ২.৪-৩.৫ কেজিভক্ষনযোগ্য (edible)সীমউৎপাদিতহয়। সেইহিসেবেহেক্টরপ্রতিসম্ভাব্য সর্বোচ্চফলনশীলতা (yield potential) ৩৫.০টন।
খ) উচ্চ লবণ সহিষ্ণুতা: ১২ ডিএস/এম লবণাক্ততা সহনশীলহওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ টি উপকুলীয় জেলাসহসমগ্র দেশে আবাদ করা সম্ভব।
গ) উচ্চ মাত্রায় অ্যান্থসায়ানিনের (anthocyanin)উপস্থিতি: উল্লেখ্য যে, বিশ্বে টাটকা সবজীতে০.৫-৩২.০ মাইক্রো গ্রাম/গ্রাম অ্যান্থসায়নিন পাওয়া যায়। নতুন জাতটিতে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্থসায়ানিন (২৯ মাইক্রোগ্রাম/গ্রামটাটকাসবজী) এর উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেছে। সীমের কাচা ফলে প্রাপ্ত অ্যান্থসায়নিন হলো পোলিফেনোলিক রঞ্জক যা পরাগায়নে সাহায্যকারী পতঙ্গ (pollinator) এবং বীজ বিস্তারককে (seed dispersers) আকর্ষন করে ফসলের বংশ বিস্তারের (reproduction) ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেই নয় বরং বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার biotic and abiotic stress) বিরুদ্ধে গাছকে সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে। তাছাড়া শাক সবজিতে প্রাপ্ত অ্যান্থসায়নিন গুলি মানবদেহের ভাস্কুলার প্রদাহ হ্রাস এবং থ্রোম্বোসিস (রক্তনালীতে রক্ত জমাটবাঁধা) প্রতিরোধে যথেষ্ট কার্যকরী বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃত হয়েছে। অধিকন্ত তারা ক্যারাটিনোসাইট অ্যাওপটোসিসকে বাধা দিয়ে ultra violet) তেজক্রিয়তা তথা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। অ্যান্থসায়নিন সমৃদ্ধ খাদ্য পন্য গুলি তাদের আকর্ষনীয় রং এর কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং তা মানব স্বাস্থের জন্যও উপকারী বলে বিবেচিত হচ্ছে Pojeret al., 2013)।
ঘ) কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী: প্রায় সব জাতের সীমই জাব পোকা (aphid) এবং জ্যাসিড( jassid) দ্বারা আক্রান্ত হয়। শীতের অর্থাৎ ফেব্রুয়ারীতে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সীমের প্রধান পতঙ্গ শত্রু অর্থাৎ এফিড এবং জ্যাসিড মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বংশ বিস্তারের কারণে ফসলটি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে ফলন কমে যায়, যা থেকে নতুন জাতটি প্রতিরোধী। উল্লেখ্য ফলে রঙ্গিন অ্যান্থসায়নিনের অস্তিত্ব (existence) পোকামাকড় ও প্যাথোজেন সমূহের সংক্রামনকে হ্রাস করে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। (Liu et al., 2018)।
ঙ) জীবনকাল: অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রোপন করলে ১৩০ দিনে ভক্ষণ যোগ্য ফল (edible maturity) সংগ্রহ করা যায়।তবে বীজ সংগ্রহের জন্য আরো ২০ দিন সময় বেশি লাগবে।
চ) ছাদ কৃষি roof top gardening)উপযোগী: বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ধারণা ছাদ কৃষির জন্য নতুন অবমুক্ত এ জাতটি একটি চমৎকার নির্বাচন হতে পারে। কেননা ফলন ও গাছের আকার বিবেচনায় একটি গাছ ছোট একক পরিবারের সীম চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে বলে সংশ্লিষ্ট প্রজনন বিদরা জানিয়েছেন।
ফসল উৎপাদন পদ্ধতি:
দেশের সকল জেলাতে শীত মৌসুমে এই জাতের বীজ রোপণ করা যেতে পারে। গোবর-মাটির মিশ্রনে ভরা (অর্ধেক-অর্ধেক) ছোট পলিথিন ব্যাগে চারা গজিয়ে পরবর্তীতে মাঠে গর্তে (চরঃ) লাগানোই উত্তম। প্রতি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর, ১০ গ্রামই উরিয়া (দুইবারে), ৩০ গ্রাম টিএসপি ও ২০গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৯০% বিবেচনায় নিয়ে প্রতি হেক্টরে ৪.০-৫.০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ লাগানোর ১৩০ দিনের মধ্যে সবজি ফসল হিসাবে সীম সংগ্রহ করা যায়। তবে বীজ সংগ্রহের জন্য আরো ২০ দিন সময় বেশি লাগবে।প্রস্ফুটিতফুলের রং বেগুনি এবং অ্যান্থসায়নিনের উপস্থিতির দরুন ফলের রং গাঢ় লালচে বেগুনী, কান্ডের রং গাঢ় বেগুনী, পাতার রং গাঢ় সবুজ, ফলের আকার লম্বায় ১২ সে.মি.ও চওড়ায় ২.৫ সে.মি, বীজের সংখ্যা ফল প্রতি গড়ে ০৪-০৫ টি এবং ১০০টি বীজের ওজন ৪৪ গ্রাম।এক কঞ্চি বিশিষ্ট বাউনী বামাচা চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে উৎপাদন করা সম্ভব বিধায় অল্প জায়গায়(১মি. ী ১মি. দুরত্বে প্রতিশতকে ৪০ টি গাছ)অধিক সংখ্যক গাছ লাগানো সম্ভব হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ গিয়াস উদ্দীন মিয়া জাতটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, “ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকি মোকাবেলায় পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে টেকসই উন্নয়ন বজায় রাখার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ গোলাম রসুল-এর নেতৃত্বে উদ্ভাবিত বিইউ সীম-৭ ব্যবহার করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত পতিত জমি উৎপাদনের মূল ধারায় আনয়ন করে সার্বিক কৃষি তথা সবজী উৎপাদনে আমূলপরিবর্তন ঘটিয়ে উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে বলে আশা করি”।