গণবাণী ডট কম:
মহামারি করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে চলমান লকডাউন এর কারণে তাকে নিয়ে ঘরে থাকাই নিরাপদ ছিল। কারণ সে তো পাগল। সব সময় তাকে বেঁধে রাখতে হয়। তাই লকডাউনের এই সুযোগে ঘরে থাকলে তো আর তাকে বেঁধে রাখতে হবে না। কিন্তু জীবন বড়ই নির্মম। এক অসাধারণ গল্পের নাম জীবন। তাকে নিয়ে ঘরে থাকলে তো জীবনের চাকা ঘুরবে না। তাই প্রচন্ড এই গরমের মধ্যেও ছেলেকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন অসহায় মা।
মায়ের নাম সালমা বেগম। অনেক বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। সংসার জীবনের একমাত্র প্রাপ্তী একটি ছেলে, ফুটফুটে একটি ছেলে। তখনো তার বাপ আলামিন বেঁচে ছিল। সংসারে আলো করে ছেলের মুখ দেখে সকলে কত আনন্দিত। দিন যায়, মাস যায়, মাস পেরিয়ে বছর যায়, ছেলে আর কথা বলে না। সাধ্যমত চিকিৎসা করে জানা গেল ছেলেটা বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। ছেলের নাম আওলাদ। স্বামী সন্তান নিয়ে থাকতেন কিশোরগঞ্জে। ছেলে যখন আরেকটু বড় হল, হাঁটতে শিখলো তার চালচলনে অস্বাভাবিকত্ব লক্ষ্য করা গেল। পরে জানা গেল, ছেলে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। ততদিনে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন স্বামী আলামিন। আওলাদের বয়স এখন ১৯ বছর।
স্বামীর মৃত্যুর পর হয়েছেন ভিটেমাটি হারা। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে অন্য অনেকের মত গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন গাজীপুরে। প্রায় এক যুগ ধরে ছেলেকে নিয়ে বসবাস করেন গাজীপুর মহানগরীর চা বাগান এলাকায়। ভাড়া করা একটি টিনশেড ঘরে সাজিয়েছেন সংসার। ঘরের ভাড়া বিদ্যুৎ বিল সহ মাসে পনেরশো টাকা। ছেলে যতক্ষণ ঘরে থাকে ততক্ষণ মা তাকে আগলে রাখেন। সেই সময় টুকুই আওলাদ স্বাধীন, মুক্ত জীবনের স্বাদ নিতে পারে। একা ছেলে কখনোই ঘরের বাইরে আসতে পারে না। কারন সে পাগল। পাগলামি করে সে অন্যের ক্ষতি করতে পারে, ক্ষতি করতে পারে নিজেরও। এই আশঙ্কায় মা তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন।
কথায় আছে, “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন”। এ কথায় যেন সত্যি হল সালমা বেগম ও তার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলের জীবনে। ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে হয় তাই মা কোন কাজ করতে অন্যের বাড়ীতেও যেতে পারেন না। তাই তাদের জীবিকার একমাত্র পথ ভিক্ষা করা। এ কাজে ছেলের শিকলবন্দি জীবন তাদের আয়-রোজগারের একটি উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ততম জয়দেবপুর রেল জংশনের পূর্ব পাশে ঐতিহ্যবাহী নাটমন্দির। এই নাটমন্দিরের প্রধান ফটকের পাশেই দেখা মেলে সালমা বেগম ও তার ছেলে আওলাদের। পাকা মহাসড়ক ও ফুটপাথের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় রেল লাইনের একটি লোহার রড দাবানো আছে। এই রডের সাথেই লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে আওলাদকে। মাথার উপরে প্রখর সূর্য, প্রচন্ড খরতাপ কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। মুখে সব সময় ফুটে আছে হাসি। পাশে মা বসে আছেন। সামনে একটি বাটি। পথচারীদের মধ্যে যাদের দয়া হয় তারা তাদের খুশিমতো দান করেন এই বাটিতে। এতেই তাদের সংসার চলে। যেন আওলাদকে শিকলে বেঁধে রাখলেই, তাদের সংসারের চাকা ঘোরে।
এখানে গত শুক্রবার কথা হয় সালমা বেগমের সাথে। কথা বলার জন্য একটু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম তাদের কাছে। আওলাদ তাকে যে খুটিতে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, সে খুটির গোড়ায় ছোট্ট একটি গর্তে জমে থাকা কাঁদা মাটি নিয়ে খেলা করছে। ব্যস্ততম নগরীর চারপাশের মানুষের এই ব্যস্ততা কোলাহল কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।
আমি ধরেই নিয়েছি যেহেতু তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে, তাহলে নিশ্চয় সে পাগল। কাছে যেতে ভয় হচ্ছিল যদি সে আমাকে জাপটে ধরে? যদি কাঁদা লাগিয়ে দেয়? কিন্তু না। আমার বাড়তি উপস্থিতি তার নজর কাড়ল না। সে এক মনে খেলা করছে।
পাশে বসতেই বিস্মিত সালমা বেগম আমার দিকে তাকালেন। এখানে কি করেন, এই রোদে কেন বসে আছেন? এই ছেলে কে? কিভাবে এলেন, কোথায় থাকেন-এমন সব প্রশ্নের শান্তভাবে উত্তর দিলেন। জানালেন তার জীবনের গল্প।
তিনি জানালেন, কিশোরগঞ্জে এক সময় স্বামী, সংসার সবকিছুই ছিল। অসুখে স্বামী মারা যাবার পর জীবনে নেমে এলো অন্ধকার।
স্বামী মৃত্যুর পর প্রায় এক যুগ ধরে বসবাস করছেন গাজীপুরে। ছেলেকে একা ঘরে রেখে কোথাও যেতে পারেন না। তাই ভিক্ষা করেই জীবন চলে। ছেলে প্রতিবন্ধী ভাতা পায় না? উত্তরে জানালেন তার ভোটার আইডি কার্ড (জাতীয় পরিচয় পত্র) নেই। বললেন, আগে তো বুঝতাম না তাই ভোটার হইছিলাম না। এখন গাজীপুর থাকি এইখানে ভোটার হমু কেমনে।
পরে জানালেন, এইখানের কাউন্সিলর এর কাছে গেছিলাম, বলছে আবার ভোটার তালিকা যখন হবে তখন আমারে ভোটার করব। ভোটার কার্ড ছাড়া ভাতা পাওয়া যায় না। এক প্রশ্নের জবাবে জানালেন দৈনিক দুই শ টাকার মত আয় হয়। এই টাকা থেকে ঘর ভাড়া, ছেলেকে নিয়ে আসা-যাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তা দিয়ে টেনে টেনে তাদের সংসার চলে।
কথা শেষ করে চলে আসার সময়ও আওলাদ নিবিষ্ট মনে খেলা করছিল। বল্লাম, ছেলেকে একটু সোজা করে বসান, ছবি তুলব। তখন মা ছেলের মাথায় হাত রাখতেই সে মায়ের দিকে ফিরে জড়িয়ে ধরে মাকে চুমু দিতে লাগল। মা তাকে ছাড়িয়ে মুখ সোজা করে ধরার পর, তার মুখে অমলিন হাসি দেখা গেল।