গণবাণী ডট কম:
এবারের ঈদ যাত্রা অন্য যেকোনো বারের চাইতে একেবারেই ভিন্ন। অন্যান্য সময়ে ঈদ যাত্রায় আশঙ্কা থাকতো হয়তো কাঙ্খিত যানবাহনের টিকিট পাওয়া যাবে না, টিকিট পাওয়া গেলেও হয়ত আসন খালি থাকবে না, ভাড়তি ভাড়া দিতে হবে অথবা পথে হয়তো দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়তে হবে। গেল ঈদের আগেও ঈদযাত্রা আনন্দদায়ক হতে পারে অথবা বিরক্তিকর এই শংকা নিয়েই মানুষ ঘর থেকে বের হয়েছিল।
কিন্তু এবারের ঈদ যাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। যারা নাড়ির টানে নিরাপদ ঘর ছেড়ে পথে নামছেন তারা জেনে শুনেই নামছেন-কাঙ্খিত যানবাহন পাবেন না, তাই যানবাহনের টিকিট পাওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। পথে নানা রকম বাধা বিপত্তি আছে জেনেও মানুষগুলো কোন এক অদেখা মায়ার জাদুর টানে জীবন বাজি রেখে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে, ঝুকি নিয়ে নাড়ির টানে দেশের বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। অনেকের মনোভাব এরকম; এই ঈদে যদি প্রিয়জনের মুখ দেখতে না পারে হয়তো আর কোনদিনও সেই প্রিয় মুখ দেখা হবে না। নাড়ির টানে পথে বের হওয়া মানুষের এই আবেগের গভীরতার কাছে উল্লেথিত ঝুকি বা করোনার ভয় কোনো কিছুই ঠাঁই পাচ্ছে না।
মহামারী করোনা সংক্রমণ রোধকল্পে সরকারের পক্ষ থেকে এই ঈদযাত্রা কে থামাতে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত মানুষ এসব বাধা উপেক্ষা করে বাড়ি ফিরতে মরিয়া। আন্তঃজেলা বাস চলাচল, ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় মানুষজন ভেঙে ভেঙে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
গাজীপুর মহানগরীর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা নরসিংদী সিলেট মহাসড়ক ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। মহাসড়কগুলো যাত্রী ও যানবাহণের চাপ এতটাই বেড়েছে যে, একদিকে লক ডাউন চলছে, তারপরেও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ফোর লেন চালু হয়েছে অনেক আগেই। তারপরেও উভয় মহমাসড়কের গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় থেকে থেমে যানজট হচ্ছে। গাড়ীর গতি কমের যাবার কারণে দীর্ঘ হচ্ছে যানবাহণের সারি। সেই সাথে বিভিন্ন বাস স্টপেজ ও এলাকায় বাড়ছে যানবাহণের জন্য অপেক্ষমান ঘর মুখো মানুষের উপচে পড়া ভীড়।
গাজীপুর মহানগরীর শিল্প কল কারখানায় ধারাবাহিকভাবে ছুটি দেওয়া শুরু হওয়াতে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার কোথাও যানবাহনের দীর্ঘ সারি, কোথাও যানজট। আর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে উত্তরবঙ্গগামী নারী পুরুষের জটলা। কোন একটি গাড়ী হোক সেটি যাত্রীবাহি বাস অথবা খালি ট্রাক-পিকআপ-আসলেই সবাই একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, কে কার আগে গাড়ীতে চড়বে। ভাড়া ৩-৪ গুন বেশী।
প্রচলিত কথা আছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার মানুষ গাড়ীতে ওঠার আগে ভাড়া মুলাইয়া (আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নেয়া) তারপরে গাড়ীতে ওঠে। এবার সেসব নেই। চলছে গাড়ীতে ওঠার প্রতিযোগিতা।
মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ট্রাকে বা পিকআপে ময়মনসিংহের ভাড়া সর্বনিম্ন ৪-৫শ টাকা। পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে মাঝে মাঝে ময়মনসিংহগামী যাত্রীবাহি বাস চলতে দেখা গেছে। সরাসরি বাস না পাওয়া গেলে, লোকাল বিভিন্ন যাত্রীবাহি বাস, লেগুনা, টেম্পু, সিএনজি, ট্রাক, পিকআপ এসবে চড়ে শুরু হচ্ছে যাত্রা। এ যাত্রায় অনেকের মুখে মাস্ক নেই। ভীড়ের কারণে ও ধাক্কাধাক্কি করার সময় অনেকেরে মাস্ক খুলে যাচ্ছে। যেখানে গাড়ীতে একটু দাড়াবার জায়গা পাওয়া স্বপ্ন, সেখানে সামাজিক দুরত্ব রক্ষা করার বিষয় চিন্তা করা পাগলামি।
অনেক যাত্রী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে তারপর যাত্রা শুরু করেছেন। অন্যান্য সময় ঈদ যাত্রায় যাত্রীরা অভিযোগ করত, যানবাহন কম, ভাড়া বেশী। এবারের যাত্রায় এমন কোন অভিযোগ নেই। সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাড়ী যাচ্ছে, এ নিয়ে তদের মধ্যে একটু বিব্রত ভাব আছে। কিন্তু যাবার পক্ষে তাদের অনেক যুক্তিও আছে।
চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য গাড়ীর অপেক্ষা থাকা নাজমুল জানালেন, তিনি একটি তৈরী পোশাক কারখানায় কাজ করেন। এবারের ঈদে বাড়ীতে যাওয়ার কথা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তাই না গেলে বাড়ীর সবাই মন খারাপ করবে, তাছাড়া ১০ দিনের ছুটি পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, এ ১০দিন এখানে থেকে আমি কি করব? তার সাথের সবাই চলে যাচ্ছে। করোনার ভয় নেই প্রশ্ন করলে, তিনি বলেন, আমরাতো এভাবে ই কাজ করি। তখন হয়নি, এখন বাড়ী গেলে করোনা হবে কেন?
খোদেজা বেগম, কালো বোরখায় আচ্ছাদিত হয়ে আছেন। সাথে একটি ব্যাগ ও একটি টেবিলযুক্ত সেলাই মেশিন। এগুলো নিয়ে তিনি যাবেন কিশোরগঞ্জ। যেখানে মানুষ দাড়িয়ে যাবার সুযোগ পাচ্ছে না, সেখানে তিনি এ মেশিন নিয়ে কিভাবে যাবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কোন ট্রাকে করে নিয়ে যাব। প্রায় এক ঘন্টা অবস্থানকালে দেখা গেল তিনি ট্রাক পাচ্ছেন না। ট্রাক থামার সাথে সাথে যাত্রীরা ওঠে পড়ছে। তিনি বলেন, গ্রামে বাড়ীতে মা আর ছোট বোন রয়েছে। তারা আশায় আছে আমি তাদের সাথে ঈদ করতে বাড়ী যাব।
মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে মহানগর পুলিশ, জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ অবস্থান করলেও তাদের তেমন তৎপরতা চোখে পড়ছে না। স্বাস্থ্য বিধি মানা, আন্ত:জেলা চলাচল আটকানো, ট্রাকে যাত্রী পরিবহণে বাধা দেয়া এসব বিষয়ে তাদের তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। পুলিশি তৎপড়তা শুধু যানজট নিরসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।