গণবাণী ডট কম:
দ্বিতীয় স্ত্রীর মন জয় করতে, দ্বিতীয় স্ত্রীর প্ররোচনায় মাদ্রাসায় অধ্যয়ণরত নিজের ঔরসজাত নিস্পাপ সন্তানকে হত্যা করেছে এক পাষন্ড পিতা। নির্মম এ হত্যাকান্ডের ৩ মাস পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গাজীপুর জেলা ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও জড়িত থাকার অভিযোগে এক সহযোগীসহ পিতাকে গ্রেফতার করেছে।
গ্রেফতারের পর পাষন্ড পিতা আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবান বন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে নিজের সন্তান হত্যার লোম হর্ষক বর্ণনায় সন্তান হত্যার কারণ প্রকাশ পেয়েছে। এতে পিতা জানিয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর দ্বিতীয় স্ত্রী তার গোপন প্রেমীকের মাধ্যমে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে চাপ দিত, তা না হলে তার সন্তান হত্যা করবে বলে হুমকি দিত। দ্বিতীয় স্ত্রীকে বেশী ভালোবাসার কারণে ও ক্রমাগত চাপে মুখে তাকে খুশী করতেই নিজের সন্তানতে হত্যা করেছে।
পিতার হাতে হত্যার শিকার হতভাগ্য সন্তানের নাম বিপ্লব আকন্দ (১৪)। পারিবারীক অশান্তির কারণে সে বাড়ী থেকে দুরে নারায়ণগঞ্জে একটি মাদ্রাসায় থেকে সেখানেই লেখাপড়া করতো। কিন্তু সৎ মায়ের লোভ লালসা তার জীবন কেড়ে নিল।
নিজ সন্তান হত্যাকারী হিসাবে যিনি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তিনি হলেন, গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানাধীন পিরুজালী আকন্দ পাড়ার মৃত আমজাদ হোসেনের ছেলে বাবুল হোসেন আকন্দ (৪২)। তার সহযোগী হিসাবে গ্রেফতার হয়েছে একই এলাকার মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে এমদাদুল (৩৫)। এরা সম্পর্কে মামা শ্বশুর ও ভাগ্নী জামাতা।
এমন বুকফাটা আর্তনাদের কথা জানিয়েছেন, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান।
তিনি আজ শুক্রবার জানান, চলতি বছরের ৮ মার্চ রাতে ভিকটিম বিল্পব আকন্দ মসজিদে নামাজ পড়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। পরে তার মা ছেলেকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করেও পায়নি। পরদিন ৯ মার্চ ভোরে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানাধীন পিরুজালী বকচরপাড়া সাকিনস্থ জনৈক সানাউল্লাহ মুন্সির চালা জমির বাঁশ ঝাড়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় বিপ্লবের মরদেহ পাওয়া যায়। মরদেহের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। পরে বিপ্লবের মা খাদিজা আক্তার জয়দেবপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানা পুলিশ ১ মাস তদন্ত করে রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ঢাকার নির্দেশে মামলাটি তদন্তভার পিবিআই গাজীপুর জেলার উপর অর্পন করা হয়।
পরে পিবিআই এর ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের তত্ত্বাবধান পিবিআই গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমানের সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটি পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুল হাসান তদন্ত করেন।
তদন্তকালে প্রাপ্ত তথ্য ও আলামত বিশ্লেষণ করে মামলা ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামী বাবুল হোসেন আকন্দকে গেল ৯ জুন রাত সাড়ে ৩টায় আসামী এমদাদুলকে ১০ জুন ভোর সোয়া ৫টায় গাজীপুর জেলার পিরুজালী এলাকা থেকে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি আরো জানান, বাবুল হোসেন প্রথম স্ত্রী খাদিজা আক্তারকে নিয়ে সুখেই ছিল। তাদের সংসারে দুটি ছেলের জন্ম হয়। কিন্তু কাল হয়ে দেখা দেয় বাবুলের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জুলিয়া। জুলিয়ার স্বভাব চরিত্র ভালো নয়। জুলিয়া নানান কৌশলে আপন ভাসুর বাবুলের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এক সময় জুলিয়া নিজের সংসার ত্যাগ করে ভাসুরের সাথে পালিয়ে যায়।
তিনি আরো জানান, ১১/১২ বছর আগে পালিয়ে আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জুলিয়াকে বিয়ে করার পর বাবুল সংসারের সুখের কথা ভেবে পৈত্রিক ২ কাঠা জমি বিক্রি করে টাঙ্গাইলে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবার বাড়িতে ঘর তৈরী করে দেয়। কিন্তু জুলিয়া সেখানে থেকে বিভিন্ন ছেলেদের নানা রকম স্মপর্কে জড়ায়। একারণে বাবুল তাকে নিয়ে পিরুজালী গ্রামে এনে বাসা ভাড়া করে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতে থাকে। জুলিয়া প্রায়ই বাবুলের বড় স্ত্রীকে মারধর করত। ফলে বাবুলের প্রথম স্ত্রী খাদিজার সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়ার ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো। একারণে মামলার হত্যাকান্ডের ঘটনার অনুমান ৩ মাস পূর্বে জুলিয়া ঝগড়া করে তার ছোট মেয়েকে নিয়ে আবার বাবার বাড়ি টাঙ্গাইল চলে যায় এবং মোবাইল ফোনে তার স্বামী বাবুলকে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে বলে। তালাক না দিলে সে তার ছোট মেয়েকে খুন করে বাবুল এবং তার পরিবারের সকলকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকী প্রদান করে। বাবুল তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কথাবার্তায় সব সময় অতিষ্ঠ থাকতো। মামলার অপর আসামী এমদাদ সম্পর্কে বাবুলের ভাগ্নী জামাই। এমদাদ এর সাথে বাবুল এর ২য় স্ত্রীর গোপন সম্পর্ক ছিল, যা এমদাদ গ্রেফতার ওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। এই সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে জুলিয়া এমদাদকে বিভিন্ন বুদ্ধি পরামর্শ দিত যাতে করে বাবুলের প্রথম স্ত্রীকে ঘড় ছাড়া করা যায়।
তিনি আরো জানান, ঘটনার অনুমান ১০ দিন পূর্বে জুলিয়া টাঙ্গাইল থেকে গোপনে পিরুজালী এসে আসামী এমদাদের সাথে দেখা করে ভিকটিমকে হত্যা করার জন্য বাবুলকে রাজী করাতে বলে। ঘটনার কয়েক দিন পূর্বে বাবুল এমদাদকে জানায় তার ছোট ছেলে ভিকটিমকে হত্যা করতে হবে এবং বাবুলকে তার কথা শুনতে বলে। পরবর্তীতে বাবুল গ্রেফতারকৃত আসামী এমদাদুল এর পরামর্শে তার ছোট ছেলে ভিকটিম বিপ্লব আকন্দকে খুন করার পরিকল্পনা করে। কারণ বাবুল তার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি খুবই দুর্বল ছিল। ভিকটিম নারায়নগঞ্জ মাদ্রাসা থেকে বাসায় ছুটিতে আসার কয়েকদিন পরে ঘটনার দিন আসামী বাবুল ভিকটিমকে নিয়ে এশার নামায পড়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়। তখন আসামী বাবুল তার ছোট স্ত্রীকে তাবিজ করার কথা বলে ভিকটিমকে প্রতিবেশী খালেকের বাসা থেকে একটি কোদাল আনার জন্য বলে। ভিকটিম এর শরীর স্থাস্থ্য ভালো থাকায় আসামী এমদাদ ভিকটিমকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেভেন আপ এর সাথে নেশা জাতীয় ঔষধ মিশিয়ে খাওয়ায়। পরবর্তীতে আসামী বাবুল তার ছেলে ভিকটিম বিপ্লব আকন্দকে নিয়ে পিরুজালী বকচরপাড়া সাকিনস্থ জনৈক সানাউল্লাহ মুন্সি এর চালা জমির বাঁশ ঝাড়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ পর ভিকটিম ঝিমিয়ে পড়তে থাকে এবং বাড়ি যাওয়ার কথা বলে মাটিতে শুয়ে পড়ে। ঠিক তখন আসামী বাবুল তার হাতে থাকা কোদাল দিয়ে ভিকটিম বিপ্লবের গলায় কোপ দেয়। ভিকটিম লাফিয়ে উঠার চেষ্টা করলে আসামী বাবুল পুনরায় কোদাল দিয়ে ভিকটিমের শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং কোদালটি পাশ্ববর্তী ঢাকাইয়ার ধানের জমিতে ফেলে বাসায় চলে যায়। পরবর্তীতে আসামী এমদাদ বাবুলের কথামত কোদালটি সেখান থেকে নিয়ে তার বাসায় লুকিয়ে রাখে।
এই বিষয়ে পিবিআই গাজীপুরের পুলিশ সুপার বলেন, বাদীনি তার স্বামীর প্রথম স্ত্রী। আনুমানিক ১১/১২ বছর আগে আসামী বাবুল তার আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে দ্বিতীয় বিবাহ করে এবং ছোট স্ত্রীর ২ মেয়েকে নিয়ে নিজের গ্রামে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত। মূলত পারিবারিক কলহের জের ধরে দ্বিতীয় স্ত্রীর প্ররোচনায় বাবুল কোদাল দিয়ে অপর আসামী এমদাদের সহায়তায় ভিকটিমের গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে নিজের ঔরসজাত সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গ্রেফতারকৃত আসামী এমদাদের দেখানো মতে ১০ জুন সকালে তার নিজ বাড়ী হতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত কোদালটি উদ্ধার করা হয়।