গণবাণী ডট কম:
দেশে গত দুই সপ্তাহে মহামারি করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার (১লা জুলাই) থেকে সাতদিনের জন্য ‘সার্বিক কার্যাবলি/চলাচলে’ নতুন ২১ দফার বিধি-নিষেধ জারি করেছে সরকার। এই এক সপ্তাহের মধ্যে ‘অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত’ বাড়ির বাইরে বের হলে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ গ্রহণ করা হবে বলে সকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা মত গাজীপুরে লকডাউন কঠোরভাবে শুরু হয়েছে। সকালে মহানগরীর কোথাও কোন যান্ত্রিক যানবাহন (পণ্যবাহী যান ব্যতিত) চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে কোথাও কোথাও এলোমেলোভাবে ২/১টি রিক্সা/অটোরিক্সা ও সীমিত মানুষজন চলাচল করেছে।
তবে, গেল ২১ জুন থেকেই লকডাউন চলছে গাজীপুরে। গত দুই সপ্তাহে করোনভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় রাজধানী ঢাকাকে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে গাজীপুরসহ ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় আগেই বৃহস্পতিবার থেকে লকডাউন জারি করেছিল সরকার। এরপরে আগের বিধিনিষেধের সাথে নতুন কিছু শর্ত যোগ করে গেল সোমবার থেকে তিনদিনের সীমিত লকডাউন জারি করা হয়েছিল। তারপরেই বৃহস্পতিবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য আরো কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এই লকডাউনে এ সব সরকারি-বেসরকারি অফিস সব ধরণের যান্ত্রিক যানবাহন (পণ্য পরিবহন ব্যতীত) বন্ধ রাখাসহ ২১ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আজ সকাল ৬টা থেকে ৭ই জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত এই লকডাউন কার্যকর থাকবে। এই লকডাউনে যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেগুলো হল:
• কাঁচা বাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। তবে ক্রয়-বিক্রয় করতে হবে উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে।
• খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। তবে তারা শুধু খাবার বিক্রি করতে পারবে, দোকানের ভেতরে গ্রাহককে সেবা দেয়া যাবে না।
• সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
• স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শিল্প কারখানা চালু থাকবে।
• শপিং মল, মার্কেট, দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
• পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ থাকবে।
• জনসমাবেশ হয় এ ধরণের সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন বিয়ে, জন্মদিন, পিকনিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা যাবে না।
• সব ধরণের যন্ত্রচালিত যানবাহন বন্ধ থাকবে।
• পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান, কার্গো ভেসেল নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
• বিমান, নৌ ও স্থল বন্দরের সাথে সম্পৃক্ত অফিস এই বিধিনিষেধের আওতার বাইরে থাকবে।
• আইন শৃঙ্খলা, জরুরি পরিষেবা, খাদ্যদ্রব্য পরিব্হণ ত্রাণ বিতরণ, রাজস্ব আদায়, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি ও বেসরকারি) গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মীরা ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
• বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকিং সেবা চালু থাকবে।
• টিকা কার্ড দেখিয়ে কোভিডের টিকা গ্রহণ করতে যাওয়া যাবে।
• অভ্যন্তরীন ফ্লাইট বন্ধ থাকবে, তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকেট দেখিয়ে গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
• স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
• বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে।
• আদালত পরিচালনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে সুপ্রীম কোর্ট।
• প্রত্যেক জেলার ম্যাজিস্ট্রেট নিজ জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভার মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহলের অধিক্ষেত্র, সময় ও এলাকা নির্ধারণ করবেন।
• মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ নিশ্চিত করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
• স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করতে পারবেন।
• অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার) বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারির পর গাজীপুর জেলায় কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে গেল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে জুম অ্যাপস এ সভা করেছেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এম তরিকুল ইসলাম। সভায় গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা: খাইরুজ্জামান, জেলা পুলিশ ও মহানগর পুলিশের প্রতিনিধি, এনএসআই, ডিজিএফআই, আনসার অ্যাডজুটেন্ট সহ বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন।
সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, সরকারের নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। সে লক্ষে জেলার সকল উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)গণ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। এছাড়া মহানগর এলাকায় নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেলা ও মহানগর পুলিশ, মহানগর ও জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট পরিচালনা করবে।
লকডাউন বাস্তবায়নে বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য সেনাসদস্যের দুটি দল ও বিজিবির তিনটি দল জেলা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টহলে থাকবে। তারা সরকারি নির্দেশনা প্রতিপালনে প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন ও উৎসাহিত করতে কাজ করবেন।
গাজীপুরের লকডাউন পরিস্থিতি :
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো তৎপরতায় কড়কড়ি লকডাউনের মধ্যেও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করছে অটোরিকশা-ইজিবাইক সহ হালকা যানবাহন। তবে মহাসড়কের অনেক জায়গায় এসব যানবাহন পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুর মহানগরীতে শিল্প কল কারখানা বিশেষত পোশাক কারখানা খোলা রয়েছে। এতে করে নানা শ্রেণি-পেশার কর্মজীবী মানুষ বিশেষ করে পোশাক শ্রমিকরা একটু বেশি বিপাকে পড়েন। কেউ কেউ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে কর্মস্থলে পৌঁছতে পারলেও আবার কর্মস্থল দূরে থাকায় অনেকেই বাসায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তারা বলছেন, হয়তো যানবাহনের ব্যবস্থা করা হোক, নতুবা তাদের কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হোক।
এসব বিষয়ে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মামুন সরদার জানান, জেলা প্রশাসন ও সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলো আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। যে কোনোভাবেই হোক সরকারের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি আরো জানান, আজ সকালে আমি মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি, কোথাও কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি, বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও দুই একজন মানুষকে রাস্তায় দেখা গেছে। এসব বন্ধ করার জন্য পুলিশের পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনা ও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, শিল্প মালিকগণ সরকারের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কারখানা খোলা রাখার অনুমতি পেয়েছেন, মালিকপক্ষ সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।
তিনি মহামারী করোনা সংক্রমণ রোধকল্পে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে সকল নাগরিকের প্রতি অনুরোধ জানান।