গণবাণী ডট কম :
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের নানা অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ তদন্ত করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুক নেতৃত্বে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার গাজীপুর নগর ভবন ও কয়েকটি সড়ক সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন।
কমিটির অপর সদস্যগণ হলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব অনুপম বড়ুয়া ও উপ সচিব জহিরুল ইসলাম ।
তদন্ত কমিটি নগর ভবনে বিভিন্ন নথি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেন। এসময় তারা ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী আকবর হোসেনসহ অন্যান্যদের সাথে কথা বলেন।
পরে তদন্ত কমিটি মহানগরীর মিরের বাজার হতে বৃন্দান হাই স্কুল হয়ে নারায়ণকুল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের সময় দুই পাশের যে সমস্ত বাড়িঘর ক্ষতিপুরণ না দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয় সে সমস্ত বাঢ়িঘর সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এসময় তারা ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের সাথে কথা বলেন।
উল্লেখ্য, গত ২২ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। চার মিনিটের ওই ভিডিওতে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের নিয়ে ‘বিতর্কিত’মন্তব্য করেন। এর ধরে গাজীপুরে ব্যাপক আন্দোলনের মূখে আওয়ামী লীগ তাকে প্রথমে শোকজ ও পরে গত ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে এক বৈঠক শেষে তাকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। একইসাথে দলে তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে। পরে গত ২৫ নভেম্বর ভূয়া টেন্ডার, আরএফকিউ, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোক নিয়োগ, বিশ্ব এস্তেমা উপলক্ষে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ও একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং প্রতি বছর হাট-বাজার অর্থ যথাযথভাবে নির্ধারিত খাতে জমা না রাখাসহ নানাবিধ অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এর পদ হইতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তখনই উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে, গাজীপুর মহানগরীর প্রিমিয়ার ব্যাংকের একটি শাখায় ব্যক্তিগতভাবে সিটি করপোরেশনের নামে একাউন্ট খুলে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে।
সিটি কর্পোরেশনের একটি সূত্র জানায়, কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত (রেজুলেশন) ছাড়াই জাহাঙ্গীর আলম অতি গোপনে নিজের একক পরিচালনায় প্রিমিয়ার ব্যাংকের স্থানীয় কোনাবাড়ী শাখায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নামে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি একটি হিসাব খুলে নিজেই সেটি পারচলা করেন। যার চলতি হিসাব নম্বর ০৩৫১১১০০০০০৫৭৮। কিন্তু পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ডকুমেন্ট ত্রুটির কারণ দেখিয়ে গত বছরের ৩ মার্চ হিসাবটি বন্ধ করে দেয়।
সিটি কর্পোরেশনের একটি সূত্র হতে ব্যাংক হিসাবের কাগজপত্র হতে দেখা যায়, হিসাবটি চালুর দিনই গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়িতে অবস্থিত ইস্পাহি ফুড লিঃ কারখানার লে-আউট প্ল্যান অনুমোদনের ফি ও জরিমানা বাবদ ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকার পে-অর্ডার এবং একই দিন ৫০ লাখ টাকার অপর একটি পে-অর্ডার জমা হয়। এছাড়া ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৫.৫০ টাকার পে-অর্ডার, একই বছরের ২৯ জুলাই ৮৫ লাখ ও ৬৭ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯০ টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার জমা হয়। এভাবে হিসাবটিতে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে মোট ২ কোটি ৬০ লাখ ২৪ হাজার ৯শত ৯৯.৫০ টাকার পে-অর্ডার জমা হয়।
ব্যাংক হিসাবের কাগজপত্র হতে দেখা যায়, এ হিসাব থেকে জাহাঙ্গীর আলম ৯৩৩২৮২৭ নং চেকের মাধ্যমে গত ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জনৈক শামীম হোসেনকে ৫০ লাখ টাকা, জাহাঙ্গীর আলম নিজে একই বছরের ৫ মার্চ ৯৩৩২৮২৮ নং চেকের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা, জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত কর্মচারী শহীদুলের মাধ্যমে ৫০৬১৯২ নং চেক দিয়ে ৬ আগস্ট মাধ্যমে ১ কোটি টাকা, মেয়রের বাসার ব্যক্তিগত কর্মচারী প্লটু চাকমাকে দিয়ে ৫০৬১৯১ নং চেকের মাধ্যমে ১০ আগস্ট ৩০ লাখ টাকা এবং একই বছরের ১৮ ও ২০ আগস্টে শহীদুলের মাধ্যমে যথাক্রমে ৫০৬১৯৩ ও ৫০৬১৯৪ নং চেক দিয়ে যথাক্রমে ৩০ ও ২০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক, ব্যাংকের এক কর্মচারী জানান হিসাবটি মেয়রের এককভাবে পরিচালনার ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের রেজুলেশন কপি চাওয়া হলে মেয়র তখন বলেছিলেন, এব্যাপারে মৌখিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী মিটিংয়ে রেজুলেশন হবে, তখন কপি দেয়া হবে। কিন্তু পরে করোনার কারণে মাসিক সভা করতে না পরাসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখালে হিসাবটি বন্ধ করে দেয়া হয়। হিসাবটি বন্ধের সময় ব্যালেন্স ছিল ৮ হাজার ২৩৫.৫০ টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ৮ হাজার ৫ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলমকে ফেরত দিয়ে বাকি ২৩০.৫০ টাকা একাউন্ট ক্লোজিং চার্জ হিসেবে কেটে নেয়।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে প্রিমিয়ার ব্যাংকের কোনাবাড়ী শাখার ব্যবস্থাপক এম মোর্শেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, হিসাবটি চালু ও বন্ধের সময় আমি এ শাখায় কর্মরত ছিলাম না। আগের ম্যানেজারই এ বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন। এব্যাপারে তৎকালীন ম্যানেজার মো. মোতালিব হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এব্যাপারে সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হিসাবটি তিনি চালু করেননি। এ সময় তিনি দাবী করেন, ‘যারা আমার বিরুদ্ধে টেপ রেকর্ডার বার করছে, ভিডিও বানাইছে, গোপনে অনেক কিছু করছে, মিথ্যা তথ্য দিছে, তারাই যদি দুই বছর আগে এইত্যা করতে পারে, তারাই তো বিভিন্ন ব্যাংকের একাউন্টেও আমার নাম দিয়া, আমার নাম ব্যবহার কইরা, আমার ভূয়া সিংনেচার দিয়া একাউন্ট কইরা; আমারে ফাঁসাইবার লাইগ্যা এইডা করছে।’
ব্যাংক হিসাব ও তদন্ত বিষয়ে মঙ্গলবার রাতে নগর ভবনে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুক বলেন, আমরা আজকে কাজ শুরু করেছি। কিছু কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকটি সড়ক সরেজমিনে দেখা হয়েছে। এগুলো যাচাই করে পুনরায় আবার আমরা আসব। এসময় তিনি তদন্তের স্বার্থে বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তারা রতেই মহানগরীর বনমালা সড়ক পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।