নিজস্ব প্রতিবেদক, কাপাসিয়া (গাজীপুর) :
সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি টিকটক স্টোরিতে একটি হাহা রিএক্টই কেড়ে নিলো তরতাজা ৩টি প্রাণ। হাহা রিএ্যাক্ট এর জের ধরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে বাঁধলে অকালেই ৩টি প্রাণ ঝরে যায়। আরো একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। তিনিসহ এ ঘটনায় আহত হয়ে আরো ৩ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গল্প নয় ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছে গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১ টায়।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পল্লী গ্রাম দক্ষিনগাঁও চরপাড়া এলাকার মরিয়ম ফাউন্ডেশনের আল্লাহু জামে মসজিদের পাশে।
নিহতরা হলেন, কাপাসিয়া উপজেলার দক্ষিণগাঁও চরপাড়া এলাকার মৃত আলম মিয়ার (নৌকার মাঝি) ছেলে নাঈম হোসেন (১৪), একই এলাকার মৃত হিরন মিয়ার ছেলে রবিন (১৫) ও আলমের (চা দোকানী) ছেলে ফারুক (২৫)। তাদের মধ্যে নাঈম ও রবিন কাপাসিয়া বাজারে কাপড়ের দোকানের কর্মচারী এবং ফারুক রাজমিস্ত্রি হিসাবে কাজ করে জিবিকা নির্বাহ করতেন। ফারুকের ২ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে।
এ ঘটনায় আহতরা হলো মির্জানগরের ইসমাইলের ছেলে হৃদয় (১৩) ও মামরদি গ্রামের আমজাদ হোসেনের ফাহিম (১৭)। নিহতদের মধ্যে নাঈম হোসেন দক্ষিণগাঁও চড়পাড়া এলাকার মৃত আলম হোসেনের এবং ফারুক হোসেন একই গ্রামের আলম হোসেনের ছেলে এবং প্রতিপক্ষের চর আলী নগর গ্রামের আবু তাহেরের জাহিদ (২৪)। কিন্তু তিনি পাশ্ববর্তী নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার কোচের চর এলাকায় নানার বাড়ীতে থেকে পড়াশুনা করেন।
এ ঘটনায় পুলিশ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলো নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার কোচের চর এলাকায় মোস্তফার ছেলে বেলায়েত (২৪),এ কই এলাকার সিরাজুল ইসলামের ছেলে শেখ শাহেদ (১৬), একই থানার দৌলতপুর গ্রামের রফিক মিয়ার ছেলে ফয়সাল (১৮) এবং কাপাসিয়ার চরমানিয়ার রিপন মিয়ার ছেলে মারুফ (১৫)।
হতাহতদের স্বজন ও পুলিশ বলছে, চরআলী নগর এলাকার জাহিদের স্ত্রী মারিয়া (২০) তার ফেসবুক ওয়ালে গত শনিবার একটি টিকটকের স্টোরি পোস্ট করেন। উক্ত পোষ্টের বিপরীতে মৃত আলম মিয়ার ছেলে নাঈম তিনটি হা হা হা ইমোজি চিহ্ন দিয়ে একটি রিএ্যাক্ট পোস্ট করেন। এর জের ধরে জাহিদের পরিচিত ইয়াছিন ফোনে নাইমকে নানা রকম ধমক ও হুমকি প্রদান করে। সে কোথায় আছে জানতে চায় এবং পেলে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। নাইম পাল্টা ধমকের সুরে তার অবস্থান জানায়। পরে নাঈম অন্যান্যদের সাথে সনমানিয়ায় একটি ওয়াজ থেকে ফেরার পথে ঘটনাস্থলে পৌছালে জাহিদ ও ইয়াছিনের নেতৃত্বে প্রতিপক্ষের ১০/১৫ জন তাদের পথরোধ করে নাঈমকে মারতে উদ্যত হয়। এসময় রবিনের বড় ভাই কি হয়ে জানতে চেয়ে বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করেন। তিনি ও তার ছোট ভাই ক্ষমা চেয়ে বাড়ীর দিকে হাটা শুরু করলে প্রতিপক্ষের লোকজন ছুড়ি দিয়ে তাদের এলোপাথারি আঘাত করলে তাদের ডাকচিকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে পাশ্ববর্তী মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে চিকিসাধীন অবস্থায় নাঈম ও ফারুক মারা যায়। কয়েকজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে রবিন মারা যায়। সেখানে প্রতিপক্ষের জাহিদ গুরুতর জখম অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। এসময় এলাকাবাসী ঘটনাস্থল হতে জনতা ছয়জনকে আটক করে পুলিশে সোর্পোদ করেছেন।
নিহত রবিনের বড় ভাই মোজাম্মেল জানান, গত শনিবার দিন রাত ১১টায় উপজেলার আড়াল জিএল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত ওয়াজ মাহফিল হতে তার সাথে রবিন, নাঈম ও ফারুক বাড়িতে ফিরছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি পৌছলে আগে থেকে ওতপেতে থাকা চৌদ্দ পনের জনের একটি সন্ত্রাসীদল ক্ষিপ্ত হয়ে নাঈমকে মারতে আসে। এসময় নাঈমের বড় ভাই তার ভাইকে মারার কারণ জানতে চাইলে তারা জানায়, তোমার ভাই নাঈম এক নারীর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে আপত্তিকর কিছু ছবি দিয়েছে। মোজাম্মেল বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করেন এবং সকলের পক্ষে ক্ষমা চান। এসময় ঝামেলা এড়াতে তিনি নাইমকে দিয়েও ক্ষমা চাওয়ান। পরে তারা বাড়ীর উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করার পর কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রতিপক্ষের লোকজন ফারুকের পেটে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। পরে পর্যায়ক্রমে নাঈম ও রবিনকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে গুরুত্বর জখম করে। এ সময় তাদের ডাক চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে আহতদের উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী থানা মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নাঈম ও ফারুকে মৃত ঘোষনা করেন। এসময় রবিনের অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো রেফার্ড করা হয়। গতকাল রোববার সকাল ৮টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় হৃদয় ও ফাহিম আহত হয়ে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদমেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
গতকাল রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল পুরো গ্রাম নিস্বব্ধ। সর্বত্রই শোকের ছায়া। নিহত নাঈমের মা নাসিমা বলেন, বাবা, আমার ছেলে ওয়াজে গিয়ে আর ফিরল না। কিভাবে কি হয়েছে আমি কিছু জানি না। আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। সে আমার সংসারের আয় রোজকার করত। তার বাবা নেই। এখণ আমাদের কি হবে?
এ বিষয়ে কাপাসিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএফএম নাসিম বলেন, সংবাদ পেয়ে রাতে সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থল যেয়ে জনতার হাতে আটকদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি। এদের মধ্যে দুইজনের শারীরিক অবস্থা অবন্নতি থাকায় চিকিৎসার জন্য রাতে গাজীপুর শহীদ তাজ উদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে নিহত ফারুকের পিতা আলম বাদী হয়ে গ্রেফতার আসামীসহ এজাহার নামীয় ১০ জন ও অজ্ঞাতনামা ৪ জনকে আসামী করে কাপাসিয়া থানায় মামলা করেছেন।