গণবাণী ডট কম:
রাজধানী লাগোয়া শিল্প নগরী গাজীপুর জেলায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বাস। জেলার এ বিপুল সংখ্যক মানুষের চিকিৎসার জন্য একমাত্র ভরসা শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে এখনো ১২৪টি পদ শুন্য রয়েছে। এখনো চালু হয়নি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিভাগ। এ কারণে জেলাবাসীর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য নতুন বিভাগ চালু ও জনবল নিয়োগের দাবি উঠেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় প্রায় ৯ বছর আগে জেলাবাসীর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতালটিকে ১শ শয্যা থেকে ৫শ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গাজীপুরে কোন ভালো হাসপাতাল নেই। তাই এখানে হাসপাতালের উন্নয়ন করা খুবই জরুরি। উক্ত সভায় হাসপাতাল ও অন্যান্য ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় সাড়ে ৯ শত কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। তখন তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করে দ্রুত চিকিৎসা সেবা প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করেন। সে অনুযায়ী ইতিমধ্যে হাসপাতালের জন্য ১৫ তলা নতুন ভবন নির্মাণ, ১০ তলা একাডেমিক ভবন, ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল ভবন, চিকিৎসক, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। অচিরেই ভবনটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে। ফলে ৫০০ শয্যার হাসপাতালটি অবকাঠামোগতভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। কিন্তু শুন্য পদ পূরণ ও প্রয়োজনীয় জনবল পদায়ন না করায় নতুন কোন বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না। ফলে প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতির অভাবে হাসপাতালটি তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর জেলার উপর দিয়ে ঢাকা ময়মনসিংহ, ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়ক চলমান রয়েছে। এছাড়াও টঙ্গী- ঘোড়াশাল আঞ্চলিক মহাসড়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এ জেলার উপর দিয়ে চলে গেছে। ফলে ব্যস্ততম এর জেলার বিভিন্ন সড়ক-মাহসড়কে প্রতিদিন ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। আর এসব দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের প্রথমেই নিয়ে আসা হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু এখানে কোন অর্থোপেডিক বিভাগ চালু নেই। ফলে দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের তাৎক্ষণিক জরুরী চিকিৎসা যথাযথভাবে অনেক সময় দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে বাড়ছে প্রাণহানি অথবা ঘটছে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যার মতো ঘটনা। গাজীপুর জেলায় প্রায় ৬০ লাখ লোকের বাস। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। কিন্তু এখানে শিশু সার্জারি বিভাগ চালু যায়নি। ফলে শিশুদের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন অথবা অন্যান্য প্রয়োজন হলে তাদেরকে এখান থেকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলাবাসীকে উন্নত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতাল যেতে আরো বেশকিছু নতুন বিভাগ চালু করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় গাজীপুরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতলে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ গুলো চালু করা এবং সেখানে নতুন পদ সৃষ্টি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য জনবল নিয়োগ করা এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে হাসপাতালটিতে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু, চর্ম ও যৌন, প্যাথলজি, অর্থোপেডিক্স, রেডিওলজি, আইসিইউ বিভাগ, চক্ষু ও ডেন্টাল সার্জন বিভাগ চালু আছে।
অপরদিকে, বর্তমা্নে চালু নেই কিন্তু জরুরীভাবে চালু করা প্রয়োজন এমন বিভাগ গুলোর মধ্যে রয়েছে এন্ড্রোক্রাইনোলজি, হেমাটলজি, সাইকিয়াট্রি, নেফ্রলজি, রেসপিরেটরি, গ্যাস্ট্রোলজি, নিউরোলজি শিশু সার্জারি বিভাগ প্রভৃতি।
জানা গেছে, যেসব বিভাগ বর্তমানে চালু নেই সেসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অনেক চিকিৎসক এ হাসপাতালে অ্যাটাচমেন্ট/প্রেষণে নিয়োজিত রয়েছেন। তারা শুধুমাত্র আউটডোরে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এসব বিষয়ে কোনো জটিল রোগীকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা এবং যথাযথ সেবা দেয়া যাচ্ছে না। ফলে এ সমস্ত রোগীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে এবং এতে রোগীর স্বজনরা নানারকম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু তাদেরকে এখানে নিয়োগ দিলে উল্লেখিত বিভাগগুলো সফলভাবে চালু করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও পরবর্তী নির্দেশনার জন্য এ হাসপাতালের পরিচালক ডা: তপন কান্তি সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর একাধিক পত্র লিখেছেন।
এসব পত্র থেকে জানা যায়, নতুন ভবনের অষ্টম তলা হতে ১৫ তলা পর্যন্ত কোথায় কোন বিভাগ চালু করা হবে একটি কমিটি করে ঠিক করা হয়েছে। সে অনুযায়ী হাসপাতালের পঞ্চম তলার উত্তর পাশে ব্রক্ঙোসকপি সেন্টার, ৭ম তলার উত্তর পাশে পেডিয়াট্রিক সার্জারি, ৭ম তলার দক্ষিণ পাশে ইএনটি, ৮ম তলার দক্ষিণ পাশে ইউরোলজি ও চক্ষু বিভাগ, ৮ম তলার উত্তর পাশে ফিজিওথেরাপি, ৯ম তলার দক্ষিণ পাশে গাইনোকোলজি, ৯ম তলার উত্তর পাশে ডায়ালাইসিস, ১২ তলার উত্তর পাশে গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি বিভাগে এনআডাজকপি সেবা, ১২ তলার দক্ষিণ পাশে নিউরো মেডিসিন ওয়ার্ড, ১৩ তলার দক্ষিণ পাশে রেডিওলজি বিভাগের সেবা চালু করার জন্য অনুমোদন চাওয়া হয়। গত ৩১ জানুয়ারি পাঠানো চিঠিতে এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদানসহ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী পদ সৃষ্টি ও পদায়নের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ও আসবাবপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মতামত প্রদান করা হয়নি। ফলে বিপুল টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন ভবনের সুফল জেলাবাসী কতটুকু পাবে তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে চিঠির জবাব না আসায় অ্যাটাচমেন্ট ও প্রেষণে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে নতুন বিভাগ চালু করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি অংশ চাচ্ছেন উক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে নতুন বিভাগ চালু করতে, কিন্তু হাসপাতালে প্রভাবশালী একটি অংশ এর বিরোধিতা করছে। তারা বলছেন, প্রশাসনিক অনুমোদনহীন বিভাগসমূহ চালুর জন্য ওই সমস্ত বিভাগের প্রশাসনিক অনুমোদন গ্রহণ এবং বিভিন্ন পদের মঞ্জুরি অত্যাবশ্যক।
এসব বিষয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালক ডা: তপন কান্তি সরকার বলেন, আপাতত আমরা চাই যে সমস্ত বিভাগ চালু রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় জনবল রয়েছে, নতুন ভবনে সে সমস্ত বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করা হোক। ভবিষ্যতে যদি নতুন বিভাগ এবং জনবল পাওয়া যায় তাহলে আবার আমরা সেখানে সমস্ত বিভাগের জন্য স্থান সংকুলানের ব্যবস্থা করব।
এ বিষয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ডা: আব্দুল কাদের বলেন, যেহেতু আমাদের এই হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরবাসীর সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। তাই আমাদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য এখনই জনস্বার্থে বিদ্যমান জনবল ও অবকাঠামোর সমন্বয়ের মাধ্যমে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।