গণবাণী ডট কম:
গাজীপুরে নিজ প্রাইভেটকারের ভিতর শিক্ষক দম্পতির রহস্যজনকভাবে মৃত্যুর পর সাত পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনো এর রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। রহস্য উদঘাটনের জন্য পুলিশ বিভিন্ন পরীক্ষা ও বিশেষজ্ঞ মতামতের ওপর নির্ভর করে আছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-দক্ষিণ)মোহাম্মদ উলতুৎমিশ বলেন,গত বৃহস্পতিবার ভোরে গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানার বড়বাড়ির বগারটেক এলাকার সড়কের পাশে দাড়ানো নিজ প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে গাড়ীতে বসা অবস্থায় এক শিক্ষক দম্পতির মরদেহ তাদের স্বজনেরা উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনাকে ঐ দম্পতির স্বজনরা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড দাবী করছেন। তারা বলছেন, গাড়ীতে তাদের সাথে থাকা কোন কিছুই খোয়া যায়নি। শুধু তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের ভাই আতিকুর রহমান বাদী হয়ে পরদিন শুক্রবার রাতে বাদী হয়ে জিএমপির গাছা থানায় অজ্ঞাতনামা আসামী দিয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। স্বজনরা সুস্ঠু তদন্ত করে এ বিচার দাবী করেছেন।
মৃত্যুবরণকারীরা হলেন, এ কে এম জিয়াউর রহমান মামুন (৫১)। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার দড়ি কাঁঠাল গ্রামের মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে। তিনি টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী মোসা: মাহমুদা আক্তার জলি (৩৫)। আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষীকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা গাজীপুর মহানগরীর ৩৬ নং ওয়ার্ডের গাছা থানাধীন কামারজুরি এলাকায় বসবাস করতেন।
পুলিশ ইতিমধ্যে একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষক দম্পতির পরিবারের বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত এমন কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এখনো কোন কিনারা করতে না পারার ফলে এ নিয়ে ওই শিক্ষকের দম্পতির কর্মস্থলের ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক এবং দুই পরিবারের স্বজনদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। তবে পুলিশ আশা করছে কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া গেলে খুব সহজেই এই মৃত্যুর রহস্যের জট খুলে যাবে। মৃত্যুর কারণ জানতে পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে,র্যা ব,পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই, সিআইডি কাজ করে যাচ্ছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেলোয়ার হোসেন জানান, আমরা ওই শিক্ষক দম্পতি স্কুল থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর মরদেহ উদ্ধারের স্থান পর্যন্ত পুরো সময়ের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ওই সময়ের ফুটেজের কোথাও বাইরে থেকে কেউ গাড়িতে প্রবেশ কিংবা গাড়িতে থেকে কাউকে নেমে যাবার মত কিছু পাওয়া যায়নি।
তাই পুলিশ এ হত্যাকান্ডটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব এবং আন্তরিকতা নিয়ে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ রহস্য উদঘাটনের জন্য পুলিশের চিন্তায় এখন দুটি বিষয় কাজ করছে। একটি হল যদি এটি হত্যাকান্ড হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে খাদ্যের সাথে কোন বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে তাদের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া আরেকটি হলো গাড়ির এসির গ্যাস নিঃসরণ জনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। উভয় কারণ যাচাই করার জন্য কিছু আলামত ও নমুনা সংগ্রহ করে ইতিমধ্যেই ঢাকায় একাধিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব প্রতিবেদন পাওয়া গেলে খুব সহজেই এই মৃত্যুর রহস্য জোট খুলে যাবে।
জিএমপির গাছা এলাকার সহকারী পুলিশ কমিশনার মাকসুদুর রহমান বলেন, আমরা ওই শিক্ষক দম্পতি বাসার উদ্দেশ্যে বিদ্যালয় থেকে রওনা হওয়ার পর ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধারে আগ পর্যন্ত সময়ের সম্পূর্ণ ফুটেজ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। এই ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, তারা কলেজ থেকে বের হয়ে একটি পেট্রোল পাম্প থেকে গাড়ির জ্বালানি সংগ্রহ করেন। সেখানে কিছু সময় ব্যয় করার পর তার এক সহকর্মী কামরুজ্জামানকে একটি স্পটে নামিয়ে দেন এবং সেখানে একটি দোকান থেকে পান ক্রয় করেন। তারপর গাড়িটি টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ উড়াল সড়কে নীচে কিছু সময় যানজটে আটকে থাকে। পরে সেখান থেকে মরদেহ উদ্ধারের স্থান বগারটেক সেখানে পৌঁছাতে তাদের সময় লাগে ২৫ মিনিটের মতো। এই সময়ের মধ্যে ওই গাড়ি থেকে কামরুজ্জামান ব্যতীত আর কাউকে নেমে যেতে অথবা ওই গাড়িতে আর কাউকে উঠতে দেখা যায়নি। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, এই মৃত্যুর ঘটনাটি গাড়ির ভিতরে যে কোন কারণের প্রেক্ষিতে ঘটেছে। এসময় তিনি আরো বলেন, ফুটেজে দেখা যায়, প্রাইভেটকারটি ঘটনাস্থেলের কাছে এসে কিছুদুর একটু ডানে বামে একে বেকে এসে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে যায়। দাড়ানোর পরও গাড়িটি চালু ছিল। পরে এর জ্বালানী শেষ হয়ে স্টার্ট বন্ধ হয়।
মরদেহ উদ্ধারের পর তাদের ছেলে ও অন্য স্বজনেরা জানান, শেষ বার পৌনে ৭টার দিকে কথা বলার সময় শিক্ষকের স্ত্রীর কণ্ঠ অনেক ভারী ও ক্লান্ত মনে হয়েছি। তাদের মুখে লালা ছিল।
এ প্রসঙ্গে জিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার দেলোয়ার হোসেন বলেন, গাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধারের সময় গাড়ির চালকের আসনে শিক্ষক বসা ছিলেন। তিনি চালকের আসনে বসে গাড়ির স্টিয়ারিং দুই হাতে ধরে রেখেছিলেন। দীর্ঘ সময় এভাবে থাকার কারণে তার হাত শক্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, যেহেতু তার হাত গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা ছিল, তাই ভিতরে কেউ তাকে আঘাত করেছে অন্য কোন উপায় হত্যা করেছে এটি সম্ভব নয়। কারণ এরকম কিছু ঘটলে তিনি আত্মরক্ষা করার জন্য স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে আত্মরক্ষার জন্য হাত অন্যদিকে সরিয়ে নিতেন। তাই গাড়ীতে অন্য কেউ ছিল না। সেক্ষেত্রে অন্য একটি উপায় রয়েছে, সেটি হল খাবারে বিষ মিশানো। তিনি বলেন, গাড়ি থেকে একটি খাবারের বাটি এবং উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি গাড়িতে উঠার আগে সিঙ্গারা খেয়েছিলেন। এসব আলামত সংগ্রহ করে সেসব খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে কোন বিষাক্ত কোন কিছুর উপস্থিতি আছে কিনা তা জানার জন্য ঢাকায় পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া তারা বিষাক্ত কিছু খেয়েছিলেন কিনা সেটি ময়নাতদন্তের পর পাঠানো ভিসেরা ও রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্টে পাওয়া যাবে। এ রিপোর্টগুলি পাওয়া গেলে খাদ্যে বিষ প্রয়োগের বিষয়টি বের হয়ে আসবে বলে তিনি আশা করছেন।
তিনি আরো বলেন, যদি খাদ্যে বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু না হয়ে থাকে তাহলে অন্য আর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে গাড়ির এসির বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ। এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য উক্ত গাড়িটি উদ্ধার করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আদালতের কাছে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ দ্বারা গাড়ির এসি এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করানোর জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ এনে উক্ত গাড়ির এসির লিকেজ হয়েছিল কিনা বা কোন বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়েছিল কিনা সেটিও পরীক্ষা করা হবে।
এর আগে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শাফি মোহাইমেন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ওই দম্পতির মরদেহের ফুসফুস ও কিডনীতে জমাটবাঁধা রক্তের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিষক্রিয়া বা অন্য কোনো কারণেও তা হতে পারে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার সিআইডি ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেলোয়ার হোসেন আরো জানান, বিষয়টিকে প্রাথমিক অবস্থায় হত্যাকাণ্ড ধরে তদন্ত কাজ এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এক্ষেত্র উক্ত দম্পত্তির কর্মস্থলে কোন বিষয় নিয়ে কারো সাথে কোন দ্বন্দ্ব অথবা ভুল বোঝাবুঝি ছিল কিনা সে বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এজন্য সন্দেহের জন্য কয়েকজনকে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ভারতীয় একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, গাড়িতে যদি দরজা জানালা বন্ধ থাকে এবং এসি চালু থাকে এই অবস্থায় কোনভাবে যদি এসির গ্যাস লিকেজ হয়ে গ্যাস নিঃসরণ হয়, বাতাসের সংস্পর্শে আসে তাহলে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস তৈরী হবে। মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষের কাজ করা জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। এজন্য মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বণ ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। নিঃশ্বাসের সাথে রক্তে মিশে যেতে পারে সে ক্ষেত্রে কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন এর প্রতিক্রিয়ায় মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে। তিনি বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করে বলেন, মানুষের প্রত্যেকটি শরীরের প্রত্যেকটি কোষ কাজ করার জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় যা আমরা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নিয়ে থাকি এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে থাকে। এসির কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস যদি দরজা জানালা বন্ধ অবস্থায় গাড়িতে নিঃসরিত হয় তাহলে একসময় গাড়ির ভিতরের অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং মানুষ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সেই বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করবে। এতে মানুষের শরীরে কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু গতে পারে।
এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণের বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা তাদের ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি জব্দ করেছি এবং সংরক্ষণ করছি। আদালতের অনুমতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ দের মাধ্যমে গাড়ির এসি এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করে দেখা হবে যে গাড়িতে কোন বিষাক্ত গ্যাস লিকেজ হয়েছিল কিনা। তিনি বলেন এর সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন পাওয়া গেলেই এই মৃত্যুর রহস্যের জোট খুলে যাবে।