গণবাণী ডটকম:
মারা গেলেন স্বৈরাচার, মারা গেলেন স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতির এক অধ্যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র সামরিক শাসক যিনি স্বাভাবিক অবস্থায় মৃত্যুবরন করেছেন। পৃথিবীর সম্ভবত একমাত্র স্বৈরশাসক যিনি ক্ষমতা থেকে প্রবল জনরোষের মুখে বিদায় নিলেও আবার মানুষের ভোটেই সংসদে এসেছেন বারংবার।
এরশাদকে বহু মানুষ ঘৃনা করে তার স্বৈরাচারী শাসনের জন্য, অনেকে ঈর্ষা করে তার নারী প্রীতির ধন্য, অনেকে আবার গালিগালাজ করে তার রাজনৈতিক চাতুরতার জন্য। ক্ষনে ক্ষনে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতো।
কারোর নিকট তিনি ছিলেন হাস্যরসের পাত্র, কারো নিকট সুবিধাবাদী রাজনীতিক, কারোর কাছে পল্লীবন্ধু। এরকম নানা অভিধানে মানুষ তাকে মনে রেখেছে। ৯ বছর দেশ চালিয় গণতন্ত্রিক আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি প্রায় ৬ বছর জেলে থাকেন জেল থেকেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৫টি আসনে দাঁড়িয়ে ৫ টি তেই জিতে প্রমাণ করেন তিনি উত্তরবঙ্গের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদী নেতা।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মানে মোহাম্মদ এরশাদ হোসেন ১৯৩০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন । তার বাবা মোহাম্মদ মকবুল হোসেন । ভারতের কুচবিহারের দিনহাটা থেকে মোহাম্মদ মকবুল হোসেন রংপুর শহরের সেনপাড়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন । মোহাম্মদ এরশাদ হোসেন পরে তার সেনা বিভাগের কমিশন লাভের সময় নাম পরিবর্তন করে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ করেন ।
মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম তার “বিরোধের প্রথম প্রহর” বইয়ে লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধে এরশাদের ভুমিকা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এরশাদ পাকিস্তানে সপ্তম ইষ্ট
বেঙ্গল বাহিনীর প্রধান হিসাবে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় এরশাদ ছুটিত রংপুরে ছিলেন।তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে এপ্রিলের প্রথম দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান এবং সপ্তম ইষ্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে পুনরায় কাজে যোগদান করেন । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসুস্থ পিতা মোহাম্মদ মকবুল হোসেনকে দেখার জন্য সেপ্টেম্বরে এরশাদ রংপুর এসেছিলেন । এবারেও
তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে পাকিস্তান ফিরে যান ।পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালি অফিসার ও
সৈন্যদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে পাকিস্তানে বিচার শুরু হলে এরশাদ সেই ট্রাইবুলানের চেয়ারম্যান/ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রাণভয়ে এরশাদ
বাংলাদেশে ফেরত আসেন , এবং চাকুরি ফিরে পাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন । তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ও কুড়িগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন মিয়া একদিন সন্ধ্যায় এরশাদকে পাজামা-
পাঞ্জাবি পরিয়ে তার উপর একটি মুজিব কোট
পরিয়ে তার হয়ে তদবিরের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “আমার ভাগ্নের চাকরিটা না থাকলে যুদ্ধ করে আমার কি লাভ হলো !!” এ কথা বলার সাথে সাথে এরশাদ শেখ মুজিবের পা ছুয়ে সালাম করেন । শেখ মুজিব তাকে চাকরিতে বহাল রাখার নির্দেশ দেন ।
৭১ থেকে ‘৮০ সাল পর্যন্ত অনেকটা চুপচাপই ছিলেন৷ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর এরশাদকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান করেন৷ এর কিছুদিনের মাথায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন এরশাদকে৷ ১৯৮১ সালে বিপথগামী সেনা সদস্যদের জিয়াউর রহমানকে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এরশাদ, যদিও এরকম অভিযোগের কোনপ্রমাণ পাওয়া যায়নি৷
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকে অনেকটা বাধ্য করেন ক্ষমতা ছাড়তে৷ একপর্যায়ে ‘৮২ সালে এরশাদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নেন বিচারপতি সাত্তার৷ সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রপতি ও সামরিক আইন প্রশাসক হন তিনি৷
১৯৮৪ সালে ১৮ দফা ঘোষণা করে বাস্তবায়ন পরিষদ তৈরী করেন৷ ওই বছরই সিনিয়র রাজনীতিকদের নিয়ে গঠন করেন জনদল৷ কিছুদিন পর জনদল পরিবর্তন করে তৈরী করেন বর্তমানের জাতীয় পার্টি৷ ১৯৮৬ সালের পাতানো নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়৷ বিরোধী দল হয় আওয়ামী লীগ৷ ‘৮৮ সালে ওই সংসদ ভেঙে দিয়ে আবারও নির্বাচন দেন এরশাদ৷ কোন দল ওই নির্বাচনে অংশ না নিলেও অনুগত বিরোধী দল বানান আ স ম আবদুর রবকে৷ এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে এরশাদের বিরুদ্ধে৷ ৯০ এর গণআন্দোলনের সময় তাকে নিয়েই ‘বিশ্ব বেহায়া’ চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান।
৯ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছেড়ে দেন এরশাদ৷ তারপরে এরশাদ গ্রেফতার হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জেল থেকে অংশগ্রহণ করেন এবং পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ৷ ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি সহ অন্যান্য অনেক দল বয়কট করলে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি হয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল। এরশাদ হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। আর ২০১৮ এর নির্বাচনের পরে তিনি হন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। যদিও বলা হয় গৃহপালিত বিরোধী দল।
এরশাদের সবই কি খারাপ ছিলো? দেশের ঔষুধ নীতি তার সময়েই করা। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনে উপজেলা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। ৪৬০ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করেন তিনি, জাতীয় প্রেস কমিশন গঠন, অবকাঠামো উন্নয়ন, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, জাতীয় ঈদগাহ নির্মাণ, তিন জাতীয় নেতার মাজারের নির্মাণ কাজ, ঢাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সহ আরো অনেক কিছুই তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে করেছেন। এরশাদের সময়েই ১৯৮৫ সালে গঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক, যা বর্তমানে অকার্যকর।
আবার নিন্দিত হয়েছেন নানান কাজের জন্য।রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার মধ্য দিয়ে সংবিধানের মূল চেতনায় আঘাত হানেন তিনি। এই সিদ্ধান্তের ফলে অন্য ধর্মের লোকজনকে এরশাদ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে পাশাপাশি রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেন এই শাসক। ঢাকা শহরের বিভিন্ন খাল ভরাট করে কালভার্ট নির্মাণ করেন তিনি যার কারনে অল্প বৃষ্টিতেই ঢাকা শহর পানিতে তলিয়ে যায়।
অনান্য সামরিক শাসকদের মতো তার হাত ও ছিলো মানুষের রক্তে রন্জিত। ১৯৮৩ সালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গুলিতে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহাসহ বেশ কয়েকজন। তারপরের বছরই ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে সেলিম-দেলোয়ারকে। ডাঃ মিলন, নুর হোসেনসহ অনেকের রক্তে রঞ্জিত হয় এরশাদের হাত।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একের পর এক বিদেশ সফর নিয়েও সমালোচিত ছিলেন এরশাদ। তাই তাকে বলা হতো গরিব দেশের ধনী প্রেসিডেন্ট।
গুজব আছে কবি এরশাদের কবিতা নাকি দেশের বিখ্যাত কবিতা লিখে দিতেন। তার লেখা গান গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোর সহ অনেকেই।
এরশাদের জীবনে নারী বিতর্ক সারা জীবনই ছিলো। মেরী, জিনাত মোশাররফ, রওশন, বিদিশা আরো অনেক। তবে এরশাদ এসব নিয়ে খুব একটা রাখঢাক করতেন না। তিনি বলতেন, “তিনি নারীদের কাছে যান না, নারীরাই তার কাছে আসে।“
এরশাদের নারী প্রীতি, কবিতা প্রীতি, ইসলাম প্রীতি সহ আরো বহু কাজের জন্য নন্দিত, নিন্দিত হয়ে থাকবেন মানুষের মনে। সারা জীবন নিজেকে রহস্যময় রাখতে পছন্দ করতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অস্পষ্ট–না সরকার না বিরোধী দল।এমন একটা ধোঁয়াশার মধ্যে দলকে রেখে তিনি বিদায় নিলেন। বিদায় নিলেন রাজনীতির নাটকীয় মঞ্চ থেকেও।