কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে, রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, রানার চলেছে, রানার! দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার। রানার! রানার! সুকান্ত ভট্রাচার্জের এ কবিতার লাইন পাঠ করলে আমাদের মনে যে ডাক পিয়নের কথা ভেসে ওঠে তেমনি জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক ডাক পিয়ন প্রতিবন্ধী লাবিবুদ্দিন (৬৫)।
বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে, হোয়াট্স অ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারের যুগে ডাক বিভাগের যেমন কদর কমেছে, তেমনি মুল্যহীন হয়ে পড়েছে পল্লীর নিভৃত গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী ডাক পিয়ন (রানার) লাবিবুদ্দিনের। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হলেও তার কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি তার জীবনে। প্রতিবন্ধী হয়েও জীবন যুদ্ধে থেমে থাকেননি তিনি। জীবন যুদ্ধে অনবরত লড়াই করে চলেছেন লাবিবুদ্দিন। ছোট বেলা থেকে শুরু করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও স্বস্তির নিশ্বাস তার ভাগ্যে জুটেনি। গত ২৬ বছর ধরে লাবিবুদ্দিন সবার খবর আনা নেওয়া করেছেন কিন্তু তার খবর নেওয়ার যেন কেউ নেই। প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র হওয়ায় তার কোন ভাল কোন বন্ধুও নেই। দুর্বিষহ ও মানবেতর জীবন যাপন কাটাচ্ছেন ডাক পিয়ন প্রতিবন্ধী লাবিবুদ্দিন।
লাবিবুদ্দিন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার চরখামের গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তিনি জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী নন। তিন বছর বয়সে তিনি ট্রাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। নিজের অক্ষমতা সত্যেও হাল ছাড়েননি লাবিবুদ্দিন। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি স্থানীয় ইকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে মানবিক বিভাগ নিয়ে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে মেট্রিক পাস করেছেন। অভাবের তাড়নায় আর লেখাপড়া করা হলোনা তার। অভাবের সংসারের হাল ধরতে একটি চাকুরীর সন্ধানে ঘুরেছেন অনেক। কোথাও চাকুরী না পেয়ে শেষে স্থানীয় ছামাদ মোল্লার মাধ্যমে পোষ্ট অফিসের ডাক পিয়ন পদে ছয়শত টাকা সম্মানি ভাতা মাসিক বেতনে চাকুরী পান। এই উপার্জনের টাকা দিয়ে তিনি সংসারের হাল ধরেছেন। পরে তার বাবা-মা তাকে বিয়ে করান। এখন লাবিবুদ্দিনের দুই মেয়ে এক ছেলে রয়েছে। মেয়ে দুজনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে জায়েদ এ বৎসর কারিগরী বিদ্যালয় থেকে এসএসসি সমমান পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছে। প্রতিবন্ধী লাবিবুদ্দিন দীর্ঘ ২৬ বৎসর যাবৎ রাষ্ট্রের কাজ করে যাচ্ছেন সামান্য সম্মানি ভাতার বিনিময়ে। এখন তার সম্মানিভাতা বেড়ে হয়েছে চার হাজার টাকা।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার লাবিবুদ্দিনকে একটি বয়স্কভাতা কার্ড করে দিয়েছেন তা থেকে সামন্য কিছু টাকা পায়। এই টাকা দিয়ে তার সংসার চালাতে হয়। বাড়তি উপার্জন করার মত তার আর কোন সামর্থ্য নেই। বয়সের ভারে এখন তিনি ন্যুয়ে পড়েছেন। তারপরও প্রতিদিন সকালে নিজ বাড়ি কাপাসিয়া উপজেলা সদর থেকে ৫ কি: মি: দুরের চরখামের থেকে গ্রামীণ মেঠো পথ পেরিয়ে কাপাসিয়া সদর পোষ্ট অফিসে আসেন। এখান থেকে ডাক নিয়ে ৪ কি: মি: পথ অতিক্রম করে শাখা ডাকঘর রাওনাট বাজারে নিয়ে যান। সেখান থেকে আবার ডাক নিয়ে ছুটে চলেন সদর পোষ্ট অফিসে। রানার প্রতিবন্ধী লাবিবুদ্দিন এভাবে দুই যুগের অধিক সময় কাটিয়েছেন অন্যের খবরা খবর, জীবন বাঁচার আকুতি ভরা চিঠি নিয়ে। সেসব চিঠিতে থাকে কতই না সুখ দু:খ আর হাসি আনন্দের কথা। কিন্তু খবরের বাহকের খবর কেউ রাখে না। অভাব আজও তার পিছু ছাড়েনি। প্রতি বৎসর দু’টি ইউনিফর্ম, ১টি ছাতা ও সামান্য সম্মানিভাতা ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছু জুটেনি।
কাপাসিয়া পোস্ট মাস্টার ইব্রাহিম খলিল জানান, লাবিবুদ্দিন শারিরীক প্রতিবন্ধী হয়েও দীর্ঘদিন ধরে ডাক পিয়ন পদে কাজ করে যাচ্ছেন। এ কাজে যে সম্মানিভাতা পায় তা দিয়ে সংসার খরচ চালানো অনেক কষ্টের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আইনে ১০ টাকা সম্মানি ভাতার ভিত্তিতে ডাক পিয়ন পদে নিয়োগ প্রাপ্তরা এখনও অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকুরি করছেন। সারাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ২৩ হাজার ৫শত জনের মত হবে। অবগেলিত ডাক পিয়নদের দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। সরকার আন্তরিক হলে লাবিবুদ্দিনদের সু-দিন আসতে পারে।