গণবাণী ডট কম:
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ এনেছে জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থাও। কিন্তু মিয়ানমারের ফার্স্ট মিনিস্টার অং সান সুচি সবসময়ই তার দেশের সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে সমর্থন করে এসেছেন এই বলে যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালানো হয়নি।
অথচ, একসময় এই অং সান সুচি’কে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে মনে কর হতো। ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি।
ধারণা করা হচ্ছে, মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনে নিজ দেশের ভোটারদের মনোযোগ ও সমর্থন আদায়ের জন্যই সুচি আন্তর্জাতিক সমাোচনার বিপক্ষে গিয়ে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের পক্ষে সাফাই গাইছেন। আর এ জন্যই নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শুনানিতে সুচি মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আসুন জেনে নেয়া যাক সুচি সম্পর্কে বিস্তারিত :
আধুনিক মিয়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চির কন্যা সুচির জন্ম হয় ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে। ১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৬৮-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে বৃটিশ নাগরিক মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই ছেলে হয়। ১৯৮৮ সালের গণআন্দোলনের সময় সু চি সবার নজর কাড়েন। সে সময় সামরিক জান্তার বিরোধী অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে গঠিত ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই তাকে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। গৃহবন্দী থাকার সময় তার রাজনৈতিক পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। গৃহবন্দী থেকেই তার দল ১৯৯০ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৮১% আসন পায়, কিন্তু সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এ ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে হৈ চৈ ফেলে দেয়। পরে সুচির দল ২০১০ সালের নির্বাচন বয়কট করে। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে সুচি সংসদের নিম্নকক্ষের এমপি হন এবং তার দল ৪৫টি ফাঁকা আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করে। ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে। সুচির প্রয়াত স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না; তাই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন যা কিনা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান।
গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে সংগ্রামের জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১) সহ আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিন কমিটির চেয়ারম্যান তাকে ‘ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা’বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আপাদমস্তক পুরোটাই বদলে যান তিনি। মানবতার পক্ষে তার সেই আগের অবস্থানে তিনি এখন আর নেই। সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি তার শর্তহীন নীরব সমর্থন বিশ্বজুড়ে তাকে নিন্দার পাত্র করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা তাকে দেয়া তাদের সম্মান সুচক পদ পদবী কেড়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারপরও মানবতার বিরুদ্ধে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর সকল অপরাধ তার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। প্রকাশ্যে তিনি সামরিক বাহিনীর সকল অপরাধের পক্ষে জোড় গলায় কথা বলছেন।
এসমনকি গণহত্যার পক্ষে কথা বলার জন্য তার অতীতের সকল অর্জন ভূলে তিনি নিজে গণহত্যার অপরাধে আসামি হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির হয়েছেন। সেখানে প্রথম দিনের শুনানীতে তার মধ্যে কোন অপরাধ বোধ বা কোন অভিব্যক্তি দেখা যায়নি।
২০১৬ সালে সু চি যখন পশ্চিম ইউরোপ সফরে যান, তখন তাকে বরণ করা হয়েছিল গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে। তার দীর্ঘদিনের সমর্থনদাতা পশ্চিমারা মনে করেছিলেন, সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি খর্ব করতে তিনি তার ক্ষমতা ও নৈতিকতার অবস্থানকে ব্যবহার করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই বদলে যেতে থাকে তার কর্মকাণ্ড।
বছরে পর বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চালানো দুটি নৃশংস জাতিনিধন অভিযানে বাড়িতে মানুষ হত্যা, নারী ও যুবতীদের ধর্ষণ, পুরো সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ তদারকি করেছে সেনাবাহিনী। এর শিকার হয়ে কমপক্ষে ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি সুচি, বরং আরও সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।
জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একবাক্যে বলে আসছে, রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। বিবিসি, রয়টার্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার অনেক ছবিসহ প্রমাণও মিলেছে।
দ্য হেগ শহরের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গ্যাম্বিয়া। গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া মামলার শুনানীতে গাম্বিয়ার বিচার-মন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদু শুনানির শুরুতে বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচার হত্যার প্রশ্নে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতেই তার দেশ আইসিজেতে এই অভিযোগ এনেছে। “সারা বিশ্ব কেন এখন নীরব দর্শক? কেন আমাদের জীবদ্দশাতে এটা আমরা ঘটতে দিচ্ছি?” তিনি বলেন, “সবাই মনে করে এখানে মিয়ানমারের বিচার হচ্ছে। আসলে এখানে বিচার চলছে আমাদের সামগ্রিক মানবিকতার।”
অনেকেরই ধারণা ছিল, মিয়ানমার বুঝি এই আদালতকেও এড়িয়ে যাবে। কিন্তু এখানেও চতুর চাল চালছে দেশটি। আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন সু চি। গণহত্যায় অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়েই লড়ছেন তিনি।
দেশের ভেতর সু চির পক্ষে একের পর এক সভা-সমাবেশ হচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই জাতিসংঘের আদালতে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুচি। এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত সুচির বন্ধুমহলও। তারা বলছেন, এতে বিশ্বজুড়ে আরও নিন্দাই কুড়াচ্ছেন তিনি। কিন্তু গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে দেশের ভেতর অবস্থান আরও সুসংহত করাই হয়তো তার মূল উদ্দেশ্য। মসনদের লোভই হয়ত তাকে বদলে যেতে উৎসাহিত করেছে।