গণবাণী ডট কম :
পাকিস্তানের প্রবাদপ্রতিম কবি ফায়েজ আহমেদ ফায়েজের আইকনিক গীতিকবিতা ‘হাম দেখেঙ্গে’ হিন্দু-বিরোধী কি না, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারতের অন্যতম নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কানপুর আইআইটি।
গত ১৭ ডিসেম্বর কানপুর আইআইটি-র একদল ছাত্র পুলিশের হাতে নির্যাতিত জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রদের প্রতি সংহতি জানাতে ক্যাম্পাসে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল - আর সেখানেই গাওয়া হয় ফায়েজের ‘হাম দেখেঙ্গে’।
কিন্তু এই গান হিন্দুবিরোধী - প্রতিষ্ঠানের এক অধ্যাপক এই মর্মে অভিযোগ জানানোর পর কর্তৃপক্ষ তা আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যার নিন্দায় সরব হয়েছেন ভারতের বহু শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট ও ইতিহাসবিদ।
১৯৭৯ সালে নিউ ইয়র্কে বসে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত কবি ফায়েজ পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত নজ্ম বা কবিতা ‘হাম দেখেঙ্গে’ - যা পরবর্তী চার দশকে হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের কন্ঠস্বর।
ভারতে এফএম রেডিও-র সুপরিচিত জকি সায়মা বিবিসিকে বলছিলেন, “১৯৮৫ সালে লাহোরের এক স্টেডিয়ামে বিখ্যাত গজল গায়িকা ইকবাল বানো গাইতে এসেছিলেন কালো শাড়ি পড়ে - প্রতিবাদের রং হিসেবে পাকিস্তানে যা তখন নিষিদ্ধ ছিল।”
“আর তারপর যখন তিনি ফায়েজের ‘হাম দিখেঙ্গে’ গান ধরলেন, পঞ্চাশ হাজার শ্রোতা তার সঙ্গে গলা মেলাল - মুহুর্মুহু উঠতে লাগল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান।”
স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তখন থেকেই তুমুল জনপ্রিয় ‘হাম দেখেঙ্গে’।
কিন্তু ভারতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত ছাত্ররা কানপুর আইআইটি-র ক্যাম্পাসে যখন সপ্তাহদুয়েক আগে এই গানটিকেই অস্ত্র করে, তখনই ‘হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত লাগার’ অভিযোগ ঠুকে দেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ভাশিমন্ত শর্মা।
তার ভিত্তিতে কানপুর আইআইটি কর্তৃপক্ষও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে - যে পদক্ষেপে পরিষ্কার সাম্প্রদায়িক নকশা দেখছেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও অ্যাক্টিভিস্ট বৃন্দা কারাট।
মিস কারাট বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ফায়েজ ছিলেন একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট। তার লেখাতে তিনি সব সময় ধর্মীয় মেটাফর বা রূপক ব্যবহার করতেন, যেটা তখন ভীষণই জনপ্রিয় আর কার্যকরী ছিল।”
“আর সারা জীবন উনি যা লিখেছেন, ওনার সেই পুরো ইতিহাসটাই মৌলবাদের বিরুদ্ধে, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা চিরকাল তাকে আক্রমেণের নিশানা করেছে।”
“১৯৫১ সাল থেকে টানা চার বছর তিনি জেল খেটেছেন দেশদ্রোহের অভিযোগে। কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচারের জন্য ১৯৫৮-তে পাকিস্তান সরকার আবার তাকে জেলে পুরেছিল।”
“ফলে আজকের ভারতেও যারা স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে, যারা ডিসেন্ট বা প্রতিবাদ সহ্য করতে পারেন না - তারাই ফায়েজকে সাম্প্রদায়িকতার রঙে চোবাতে চাইছেন। ঈশ্বর তাদের রক্ষা করুন, আমার এটুকুই বলার”, মন্তব্য বৃন্দা কারাটের।
আজীবন ‘কমিউনিস্ট’ ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ ছিলেন পাকিস্তানে সেই হাতে-গোনা বুদ্ধিজীবীদের একজন - যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
১৯৭১-র মার্চেই পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘হাজার করো মেরে তন সে’ (আমার থেকে দূরে থাকো) - যে কবিতাটি ‘বাংলাদেশ-১’ নামেও পরিচিত।
সেই ফায়েজের কবিতার পংক্তিকে হিন্দুবিরোধী বলা হচ্ছে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের কিছু হতেই পারে না - বলছেন ভারতের বিখ্যাত কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতার।
জাভেদ আখতারের কথায়, “হাম দিখেঙ্গের এক জায়গায় আছে - ‘গুঞ্জেগা অনলহক কা নাড়া’। এই অনলহক কি জিনিস, অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। তারা জানেন না, অনলহক মানে অহম ব্রহ্ম, আমিই ব্রহ্ম।”
“এটা কিন্তু ইসলামী ভাবনা নয় - বরং এটা অদ্বৈত বেদান্তের দর্শন, সুফিবাদের ভাবনা - যেখানে স্রষ্টা আর সৃষ্টি এক হয়ে যান!”
প্রবীণ ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবও সখেদে বলছেন, “আপত্তি থাকলে ফায়েজ পড়ার দরকার নেই - তাতে লোকসান তোমাদেরই।”
“কই, পাকিস্তানের মুসলিমদের তো ‘অনলহক কা নাড়া’ পড়তে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না?”
“ভারতীয়দের অসুবিধা হলে পড়বেন না, মিটে গেল। কিন্তু ফায়েজের সঙ্গে হিন্দুত্বের কী সম্পর্ক?”, প্রশ্ন ইরফান হাবিবের।
ফায়েজকে হিন্দুত্বের প্রিজম দিয়ে বিচার করতে গিয়ে ভারতের অন্যতম সেরা প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতিষ্ঠান কানপুর আইআইটি যে নিজেদেরই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
চাপের মুখে এখন তারা সুর কিছুটা নরম করলেও সেই তদন্ত কমিটি কিন্তু এখনও ভেঙে দেয়া হয়নি! খবর : বিবিসি।