গণবাণী ডট কম:
২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা মাথায় রেখে দিল্লির ঘটনার পর আবারো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করছেন অনেকে৷ সেই মোদীই আসছেন জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ এর অন্যতম অতিথি হিসেবে৷ অথচ বঙ্গবন্ধু তাঁর অসাম্প্রদায়িক নীতির জন্য পরিচিত ছিলেন৷
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ প্রথমদিকে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী আসবেন এটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুব খুশীর সংবাদ ছিলো। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লিতে মুসলমানদের উপর সহিংসতার পর মোদীর সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে বাংলাদেশে৷ প্রশ্ন তুলছেন ভারতীয়রাও৷ এসব বিষয় নিয়ে জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গণবাণীর পাঠকের জন্য একটু পরিমার্জিত আকারে তুলে ধরা হলো।
জাতির জনকের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা:
অনেকেই বলেন, মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার থেকে এলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে (ভাষা ও ঐতিহ্য) বড় করে দেখেছেন৷ ‘বাঙালি’ শব্দটিই ছিল জাতীয়তাবাদের একটি অসাম্প্রদায়িক পরিচয়৷ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি তারিক আলী বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর যে বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত করে তা হলো, কেমন করে মুসলিম লীগের ছাত্রনেতা থেকে তিনি বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের নেতা বনে গেলেন৷’’
সব ধর্মের মানুষের মাঝে একতা:
ভারতের সাংবাদিক পিকে বালাচন্দ্রন তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, ‘‘মুজিবের অসাম্প্রদায়িক চেতনা কিন্তু ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়৷ তাঁর কাছে অসাম্প্রদায়িকতা ছিল সব ধর্মের মানুষের মাঝে একতা৷’’ তিনি আরো লিখেছেন, একইভাবে মহাত্মা গান্ধীও ভাবতেন৷ গান্ধী হিন্দু ধর্ম পালন করলেও সব ধর্মের মানুষের নেতা ছিলেন৷
ভিন্নতায় অভিন্নতা:
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেছেন, ‘‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) ভিন্নতার মাঝে মিল তৈরি করেছেন এবং জাতীয়তাবাদ ও ধর্মকে এক করেছেন৷’’
অসাম্প্রদায়িক ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান:
সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, ‘‘অনেকে বঙ্গবন্ধুকে ‘বুর্জোয়া নেতা’ বলতে চাইলেও তিনি কিন্তু এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধে ও শোষিতের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন৷ শুধু তাই নয়, তিনি ধর্মীয় রাজনীতিকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে পরিণত করেছেন এবং অসাম্প্রদায়িক শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ তৈরি করেছেন, যা আমাদের মুক্ত দেশের প্রথম দিককার শব্দ৷’’
নরেন্দ্র মোদীর ‘সাম্প্রদায়িকতা’ :
২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাঁধে৷ সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর হিন্দু উগ্রবাদীদের হামলায় শত শত মুসলিম নিহত হন৷ অনেক হিন্দুও তাতে মারা যান৷ অভিযোগ আছে, রাজ্য সরকারের মদদে এই হামলা চালানো হয়৷ তখন বিজেপি ক্ষমতায় এবং নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী৷ তখন থেকেই মোদী সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে একেবারে খোলাখুলি অভিযুক্ত হন৷
ফ্যাসিস্ট:
ঘটনা চলাকালীন বিখ্যাত লেখক অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘‘এটা মানতেই হবে, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের মদতে পুষ্ট জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেওয়া জনতাই প্রথম হামলা চালিয়েছিল৷ পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে বা অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিসংযোগে সাহায্য করেছে৷ মারধর করেছে রাস্তায় পড়ে থাকা যুবকদের৷ আমরা জানি সেই যুবকদের মধ্যে একজন মারা গেছেন৷ হিংসায় নিহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু-মুসলিম সবাই ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের শিকার৷’’
দ্বিচারিতা :
ভারতীয় গীতিকার জাভেদ আখতার বার বার মোদীর সমালোচনা করেছেন সিএএ-এনআরসি নিয়ে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘বিজেপি বলছে তাঁরা প্রতিবেশী দেশের খ্রিস্টানদের নাগরিক করবে৷ আর বেঙ্গালুরুতেই যিশুর মূর্তি গড়তে বাধা দিচ্ছে তাঁরা৷ অসাধারণ! গোটা বিষয়টাই অর্থহীন৷’’
‘বরং হিংসা ছাড়ুন’-রাহুল :
গেল রোববার নরেন্দ্র মোদী টুইট করে জানিয়েছেন, তিনি ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউব থেকে বেরিয়ে যাবার চিন্তা করছেন৷ এর জবাবে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘‘আপনি সামাজিক গণমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট নয়, বরং হিংসা ছাড়ুন৷’’
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ যতটা একাত্ম, ততটাই একাত্ম ভারতের বাঙালিরা৷ শুধু বাঙালি নয়, বঙ্গবন্ধুর প্রতি আম ভারতীয়ের এক অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি আছে৷ উদারপন্থি ভারতীয়দের কাছে মহাত্মা গান্ধীর যে সম্মান, ততটাই সম্মান বঙ্গবন্ধুর৷ এহেন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বের জন্মশতবার্ষিকীতে নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতি কতটা বাঞ্ছনীয়, তা নিয়ে ভারতের এক বড় অংশের মানুষ সন্দিহান৷ ঠিক যতটা তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোদীর অংশগ্রহণ নিয়ে৷
তাঁরা বলছেন, এমন অনুষ্ঠানে ব্যক্তি মোদীর অবস্থান কতটা সমীচীন? ভারতের শাসক দলের হাত ধরে যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির চাষ হচ্ছে গোটা দেশ জুড়ে, তা কি আদৌ বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তির সঙ্গে যায়?
লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই নিবিড়৷ শেখ মুজিব আমাদের সকলের কাছে বঙ্গবন্ধু৷ বাংলাদেশের মানুষের কাছেও ভারত নিয়ে একটা মস্ত আবেগ বরাবর কাজ করে৷ আমরা বন্ধু৷ কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই জায়গাটাই নষ্ট হতে বসেছে৷ এটা আমাদের কাছে লজ্জার৷ যে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সোনার সম্পর্ক, তার সঙ্গে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে, দাঙ্গা নিয়ে আমাদের তিক্ততা তৈরি হল৷ এর দায় মোদীকেই নিতে হবে৷”
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক পবিত্র সরকার৷ সাম্প্রতিক বিতর্ক নিয়ে তাঁর স্পষ্ট মত, ‘‘বাংলাদেশের মানুষের ভাবাবেগকে সম্মান জানিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সেখানে না যাওয়াই উচিত৷ যে কোনও একটা অজুহাত দেখিয়ে তিনি সফর বাতিল করতে পারেন৷ তিনি গেলে আরও একটা সমস্যা হবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খানিকটা বিড়ম্বনায় ফেলা হবে৷ কারণ তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আগেই ডেকে ফেলেছেন৷ তাঁর পক্ষে এখন পিছিয়ে আসা কঠিন৷”
বাংলাদেশ অবশ্য কেবল নরেন্দ্র মোদীকেই ডাকেনি৷ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীও আমন্ত্রিত৷ বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠানে তাঁদের যাওয়া নিয়ে কারও কোনও আপত্তি নেই৷ একমাত্র সমস্যা মোদীকে নিয়েই৷ অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, যাঁরা বিষয়টিকে ভারত বিদ্বেষ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন, তাঁরা সত্য এড়িয়ে যাচ্ছেন৷ প্রতিবাদ হচ্ছে ব্যক্তি মোদীকে নিয়ে৷
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি এবং সাংসদ দিলীপ ঘোষ অবশ্য সে কথা মানতে নারাজ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘সফর বাতিলের প্রশ্নই ওঠে না৷ পশ্চিমবঙ্গের কিছু দেশবিরোধী বাঙালি এ সব প্রচার করে দেশকে ছোট করার চেষ্টা করছে৷ নরেন্দ্র মোদীকে আটকাবে, এমন হিম্মত কার আছে?”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার মনে করছেন, বাংলাদেশ চাইলে এখনও মোদীর নিমন্ত্রণ বাতিল করতে পারে৷ কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যক্তি হিসেবে ভারত থেকে প্রণববাবু কিংবা সোনিয়া গান্ধীকে ডেকেছে৷ কিন্তু মোদীকে ডেকেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে৷ সেখানে মোদী না বসে অন্য যে কেউ বসলে তাঁকেই ডাকা হতো৷ ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তাতে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ মোদীর সফর বাতিল করবে বলে মনে হয় না৷ যদি করে, তা হলে তার কূটনৈতিক প্রভাব দু’দেশের উপরেই পড়বে৷ কোনও দেশই সেটা চাইবে বলে মনে হয় না৷”
সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে লাগাতার আন্দোলনরত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বক্তব্য, ‘‘মোদী তো নিজের দেশেই স্বাগত নন৷ তিনি এবং অমিত শাহ যতবার বাংলায় এসেছেন, আমরা রাত জেগে প্রতিবাদ দেখিয়েছি৷ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও সেই প্রতিবাদটাই দেখাচ্ছেন৷ সেখানে কূটনীতির কোনও জায়গা নেই৷ আবেগের জায়গা আছে৷ শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষ বাঙালির তেমনই এক আবেগের জায়গা৷ সেখানে কূটনীতি নিয়ে কেন ভাববো আমরা? প্রতিবাদ ছিল, আছে এবং থাকবে৷”