গণবাণী ডট কম:
সারা দেশে চলমান বোরো ধান কৃষকের ঘরে উঠলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশে খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনা নেই। বোরোর বাম্পার ফলন ও পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকার কারণে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বোরোর বর্তমান ও আসন্ন মজুদ শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমন ধান প্রস্তুত হয়ে যাবে।
অপরদিকে, মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস বলছে, ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর ধরে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতদিন ধরে চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়া। তবে এবার ইন্দোনেশিয়াকে টপকে সেই অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য নিয়ে গত বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় হওয়ার এ পূর্বাভাস দিয়েছে ইউএসডিএ। প্রতিবেদনে বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কৃষিপণ্যের উৎপাদনের তুলনা করা হয়েছে।
চলতি বোরো মৌসুমে সাড়ে চার লাখ টন বাড়তে পারে ধানের উৎপাদন। তার আগে চলতি অর্থবছরে আমন মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। আবার আউশ মৌসুমেও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তিন মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্মিলিত ফলাফলই শীর্ষ তিনে চলে আসার মূল কারণ বলে জানা গেছে।
দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। দীর্ঘদিন ধরেই খাদ্যশস্যটি উৎপাদনে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল চতুর্থ। তবে এবার ইন্দোনেশিয়াকে টপকে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারা বিশ্বে ৫০ কোটি ২০ লাখ টন ছাড়াতে পারে ধানের উৎপাদন, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে চীন সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করবে। দেশটি চলতি অর্থবছরে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদনের মাধ্যমে শীর্ষস্থানে থাকবে। চীনের পরই পাশের দেশ ভারতের অবস্থান। ভারত চাল উৎপাদন করবে ১১ কোটি ৮০ লাখ টন।
এরপরই ৩ কোটি ৬০ লাখ টন উৎপাদন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসবে বাংলাদেশ। অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরেই তিন নম্বর স্থানটি দখলে রাখা ইন্দোনেশিয়া এবার চতুর্থ অবস্থানে নেমে আসবে। দেশটিতে চালের উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৪৯ লাখ টন।
ইউএসডিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবার চাল উৎপাদনের শীর্ষ ১২টি দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরই থাকছে ভিয়েতনাম। দেশটিতে এবার উৎপাদন দাঁড়াবে দুই কোটি ৭৫ লাখ টন। এছাড়া থাইল্যান্ডে দুই কোটি চার লাখ টন, মিয়ানমারে এক কোটি ৩১ লাখ টন, ফিলিপাইনে এক কোটি ১০ লাখ টন, জাপানে ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টন, পাকিস্তানে ৭৫ লাখ টন, ব্রাজিলে ৬৯ লাখ ও কম্বোডিয়ার প্রায় ৫৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে।
তবে দেশের বিশেষজ্ঞরা যোগ করেছেন, আগামী দিনে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে মাছ, গবাদি পশু ও শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করা। শাকসবজি ও মাছ চাষিরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে না পারার কারণে ইতিমধ্যে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন।
আমনের ফলন বৃদ্ধি, উচ্চফলনশীল গম ও সরকারি গোডাউনগুলোতে মোটামুটি ভালো পরিমাণে খাদ্যশস্য মজুত থাকার পাশাপাশি বোরোর ভালো ফলন সম্ভাবনার আশ্বাস দেয়। এর থেকে আশা করা যায় কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে খাদ্য পর্যাপ্ততার দিক থেকে দেশ ভালো অবস্থানে থাকবে। তবে, উদ্বেগের বিষয় দাম। যেসব অঞ্চলে বোরো উত্পাদন হচ্ছে সেখানে দাম বাড়ার কারণে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রী সাধন কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকায় খাদ্য নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বোরো সংগ্রহ শুরুর আগেও আমাদের ১২ লাখ ৭৫ হাজার টন চালের মজুদ ছিল। এখন বোরো ও গম সংগ্রহ শুরু হয়েছে। সুতরাং কয়েক মাসের জন্য কোনো প্রকার উদ্বেগ নেই।’ সরকারি এই মজুত শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের সহায়তার জন্য সরকার ব্যবহার করে। তবে ফসলের মূল অংশ থেকে যায় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের হাতে। এবং চলতি বছর বোরো উত্পাদন ভালো হয়েছে বলে তিনি জানান।
সরকারি খাদ্য মজুত :
১১ মে পর্যন্ত সরকারি গোডাউনগুলোতে চালের মজুদ ছিল ৯ লাখ ৯৭ হাজার টন এবং গমের মজুত ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার টন। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে সরকারি গুদামগুলোতে বর্তমান খাদ্য মজুদ ‘সন্তোষজনক’।
সরকার ২৬ এপ্রিল থেকে ধান ও গম সংগ্রহ শুরু করেছে মোট ৮ লাখ টন ধান ও ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে।
খাদ্য বিভাগ ১১ মে পর্যন্ত ১০৪ টন ধান এবং ৮২৬ টন চাল কিনেছে। এ ছাড়াও তারা এ বছরের ফসল থেকে ১৫ হাজার ২৮০ টন গম সংগ্রহ করে ফেলেছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫ হাজার টন।
সরকারের গুদামগুলোতে ১৯ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করার সক্ষমতা রয়েছে। খাদ্য মজুদ ছাড়াও বাজারে ধানের বেশ ভালো সরবরাহ রয়েছে।
বোরো চাল :
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকরা ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছেন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবির বলেন, ‘ফসল কাটার তথ্যের ভিত্তিতে, এটা বলা যেতে পারে যে আমরা এই বোরো মৌসুমে ২ কোটি চার লাখ টন বোরো উত্পাদন লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হব। যেহেতু আমরা ভালো ফলন পেতে চলেছি তাই আগামী সাত থেকে আট মাস ধানের মজুদ থাকবে। কোনো সমস্যা হবে না।’
এ ছাড়া শাহজাহান জানান, আসন্ন ধানের মৌসুমের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় প্রণোদনা দিয়েছে। মন্ত্রণালয় গত মাসে আউশ মৌসুমে কৃষকদের উত্সাহিত করতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বীজ ও সার সরবরাহের জন্য ৯ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের মালিকানাধীন পাম্পগুলোর জন্য সরকার সেচের চার্জ অর্ধেক কমিয়েছে।
আগাম মৌসুমে আউশ চাষের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১৩ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর করা হয়েছে। যা আগের মৌসুমের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। আউশ উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ টন, যা আগের বছর ছিল ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টন।
বিআরআরআই-এর মহাপরিচালক বলেন, ‘আমন নিয়ে আমরাও ভালো পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে সবকিছুই ভালো হবে।’ বছরের এপ্রিল-মে মাসে বোরো ফসল কাটা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মোট উৎপাদিত ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন চালের মধ্যে বোরো ছিল প্রায় ৫৪ শতাংশ।
এর পাশাপাশি বৃষ্টি নির্ভর আমন ধান মৌসুমে ৩৮ শতাংশ এবং আউশ ধান মৌসুমের বাকী আট শতাংশ উৎপাদন পূরণ করে।
শাহজাহান কবির জানান, বাংলাদেশের বার্ষিক চাহিদা সাড়ে ৩ কোটি টন। এবং প্রাক্কলন করা চাহিদার তুলনায় গত বছরের মোট উত্পাদন বেশি হয়েছে। সম্ভাব্য উৎপাদন দেখাচ্ছে যে গত বছরের উৎপাদন চাহিদার থেকে বেশি ছিল। এবং উত্পাদন বৃদ্ধির ফলে দেশকে আমদানিকৃত চালের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়তা করেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ের প্রথম থেকে মে মাসের মধ্যে ধানের আমদানি ৯৮ শতাংশ কমে চার হাজার ১৮০ টন হয়েছে। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল দুই লাখ ৫ হাজার ৭৯০ টন।
বিআরআরআই-এর মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা ধান উৎপাদনে স্বাবলম্বী। আমরা প্রতি তিন মাসে উৎপাদন ও ধান কাটার তথ্য রেকর্ড করি। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষের সুযোগ নেই। মূল কাজটি হচ্ছে সবার কাছে এগুলো পৌঁছে দেওয়া। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি রোধে বাজার পর্যবেক্ষণও করা উচিত।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ এম এ সাত্তার মণ্ডল জানান, ফসল কাটার বাকি সময়গুলোতে প্রতিকূল আবহাওয়া না থাকলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চাল নিরাপদেই কৃষকের ঘরে উঠবে।
কতটা খাদ্য প্রয়োজন :
আমাদের প্রতিবছর কতটা খাদ্য প্রয়োজন? এ প্রশ্নের জবাবে কৃষি গবেষক ও আইএফপিআরআইয়ের বাংলাদেশের প্রতিনিধি আক্তার আহমেদ ইউএসডিএর গবেষণার বরাত দিয়ে জানান, মে ২০১৯ থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩ কোটি ৫৮ লাখ টন খাদ্যশস্য (চাল ও গম) সরবরাহ হয়েছে। ইউএসডিএ মাসিক পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে গত এক বছরে মোট ৩ কোটি ৮৮ লাখ টন খাদ্যশস্য ভোগ করা হয়েছে।
শাকসবজি এবং প্রোটিনের উৎস:
খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান জানান, একবার বোরো ফসল উঠলে দেশ কমপক্ষে আগামী ছয় মাস কোনো খাদ্য সংকটের মুখে পরবে না।
তাই, সরকারের এখন শাকসবজি ও অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ ঠিক করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত বলে তিনি যোগ করেন। তিনি বলেন, ‘কৃষকরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের উৎপাদিত সবজি পাঠাতে পারছেন না। সরকারের উচিত তা অবিলম্বে এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া।’