বিশেষ প্রতিবেদক, গণবাণী ডট কম:
কাঁঠালের জন্য খ্যাত গাজীপুর। বলা হয়ে থাকে কাঁঠালের রাজধানী। আর গাজীপুর জেলায় যে পরিমাণ কাঁঠাল উৎপাদিত হয়, এর প্রায় তিন ভাগের একভাগই উৎপাদিত হয় জেলার শ্রীপুর উপজেলায়। ফলে উপজেলা ব্র্যান্ডিং এর ভাস্কর্য ‘কাঁঠাল’। আর উপজেলার অফিশিয়াল স্লোগান, ‘সবুজে-শ্যামলে শ্রীপুর, মিষ্টি কাঁঠালে ভরপুর।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, উঠানে কাঁঠাল গাছ নেই-এমন বাড়ি খুবই কম। অনেক পরিবার রয়েছে, বছরের সংসার খরচের সিংহভাগটাই আসে এক মৌসুমে কাঁঠাল বিক্রি থেকেই।
এই উপজেলায় এবার কাঁঠালের উৎপাদনও হয়েছে গত বছরের চেয়ে বেশি। কিন্তু এবার নভেল করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে মাথায় হাত প্রায় সবার। বিক্রি করতে না পারায় কারো বাগানে কাঁঠাল পেকে পঁচে নষ্ট হচ্ছে গাছেই। কেউ-বা তিন ভাগের একভাগ দামে বিক্রি করেছে কাঁঠাল। আর বাজারে চাহিদা না থাকায় তা কিনেও পুঁজি হারানোর শঙ্কায় পড়েছে পাইকাররাও।
কাঁঠালবাগান মালিকদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও এখনো পর্যন্ত শ্রীপুরে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে ফলন বেশি হলেও অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারাচ্ছে কাঁঠাল।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, শ্রীপুর উপজেলায় এবার ৭৭ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার ধরা হয়েছে ৩৮ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবার কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে গত বছরের চেয়ে ২ হাজার ১৯০ মেট্রেক টন বেশি।
বাগান মালিকরা জানায়, প্রতিবছর মৌসুম শুরু হওয়ার এক-দেড় মাস আগেই বাগান নিয়ে পাইকারদের কাড়াকাড়ি পড়ত। কিন্তু এবার চিত্র ভিন্ন। উপজেলার বাইরে থেকে কোন পাইকারের দেখা মেলেনি। স্থানীয় পাইকারদের মধ্যেও আগ্রহ অনেক কম ছিল। আর আগ্রহ দেখালেও দাম বলত কম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রতিবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে বাগানে ফলন দেখে কাঁঠাল কিনে নিত। পরে পুরো মৌসুমজুড়ে তারা তা বিক্রি করত। এবার এইসব পাইকাররা আসেনি। এতে স্থানীয় পাইকারদের কেউ কাঁঠাল কিনেছে অর্ধেকেরও কম দামে। আবার স্থানীয় অনেক পাইকারই এবার পুঁজি হারানোর শঙ্কায় কাঁঠাল কিনেনি।
বরমী ইউনিয়নের বরকুল গ্রামের মাহমুদুল হাসান তানজিম জানান, বারবার স্থানীয় কয়েকজন পাইকারকে খবর দিয়েও আনা যায়নি। ফলে তাঁর বাগানের কাঁঠাল এখনো বিক্রি করতে পারেননি তিনি। তিনি আরো জানান, একই অবস্থা তাঁর চাচাত ভাই এস এম জাহাঙ্গীর আলমেরও। বিক্রি করতে না পারায় তাঁদের কাঁঠাল গাছেই পেকে পঁচে নষ্ট হচ্ছে।
সাতখামাইর গ্রামের ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী জানান, প্রতিবছর তিনি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা কাঁঠাল বিক্রি করেন। এবার গাছে কাঁঠালের ফলন বেশি হলেও পাইকারের আগ্রহ না থাকায় বাধ্য হয়ে মাত্র দুই হাজার টাকায় কাঁঠাল বিক্রি করেছেন তিনি।
কাওরাইদ ইউনিয়নের হয়দেবপুর গ্রামের শাহাব উদ্দিন ম-ল জানান, গতবছর যে বাগান তিনি দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন, এইবছর তা মাত্র ৭৮ হাজার টাকা বিক্রি করতে বাধ্য হন। অথচ গত বছরের তুলনায় এইবার তাঁর বাগানে কাঁঠালের ফলন প্রায় দ্বিগুণ।
বরমী ইউনিয়নের খলারটেক গ্রামের বাগানমালিক মফিজুর রহমান বাবুল জানান, পাইকারদের কাছে গেলে তারা জানায়, আড়তদাররা কাঁঠাল কিনছে না।
জৈনাবাজার কাঁঠালের আড়তদার জহির উদ্দিন জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির জন্য দেশের কোনো এলাকা থেকেই কাঁঠাল ব্যবসায়ীরা আসতে পারছে না। ফলে আড়তদাররাও কাঁঠাল কিনছে না। তিনি আরো জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকার বড় বড় কাঁঠাল ব্যবসায়ীরা তাঁদের যে চাহিদা জানায়, ওই হিসেবে কাঁঠাল আড়তে মজুত করেন তাঁরা। কিন্তু এবার কাঁঠাল ব্যবসায়ীদের সাড়া পাননি তাঁরা।
এদিকে এরই মধ্যে উপজেলার সকল হাটবাজারে কাঁঠালের বাজার বসছে। কিন্তু ক্রেতা নেই। শ্রীপুরের সবচেয়ে বড় কাঁঠালের বাজার জৈনা। সেখানে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে কাঁঠালের বাজার বসত। এখান থেকেই কাঁঠাল যেত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি বিদেশেও। রাত-দিন কাঁঠাল বিক্রি হত এই বাজারে। গত ৫ জুন থেকে কাঁঠালের এই হাটটি চালু হলেও ক্রেতার দেখা মিলছে না। জৈনাবাজার গিয়ে দেখা গেল, কাঁঠাল হাটটির জৌলুশ নেই। হাটের ইজারাদার শাহীন আলম জানান, প্রতিবছর এই হাটটি জমজমাট হয়ে উঠে উপজেলার বাইরে থেকে কাঁঠাল ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে। কিন্তু এবার কোন ব্যবসায়ীই আসেনি। ফলে তিনি এরই মধ্যে কোনো কাঁঠাল বিক্রেতার কাছ থেকেই টোল নেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন।
বাজারে বিক্রির জন্য কাঁঠাল নিয়ে আসা শফিকুল সর্দার জানান, সকালে ১০০ কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন তিনি। মাত্র ১৫টি কাঁঠাল বিক্রি করেছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখে বাকি কাঁঠাল ফেরত নিয়ে যাবেন বলে জানালেন তিনি।
বাজারে ক্রেতা না থাকার প্রসঙ্গে কথা বললে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বন্যা জানান, তাঁরা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সেখান থেকে তাঁদের জানানো হয়েছে, শ্রীপুরের কোন বাগানমালিক যদি ক্রেতা না পায়, সেক্ষেত্রে তারা (কৃষি বিপণন অধিদপ্তর) নিজেদের পরিবহন ব্যবস্থায় ঢাকায় নিয়ে তা বিক্রির উদ্যোগ নেবে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আরো জানান, তাঁরা মাঠে আছেন। ক্রেতা পাচ্ছেন না, এমন বাগানমালিকদের তালিকা তৈরি করছেন। দুই-একদিনের মধ্যে তা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে পাঠানো হবে। এই ব্যবস্থায় বাগানমালিকদের কোন পরিবহন খরচ পড়বে না।
সুমাইয়া সুলতানা বন্যা আরো জানান, এই উপজেলায় খাজা ও গালা দুই জাতের কাঁঠাল উৎপাদন হয়। আর এর চাহিদাও দেশজুড়ে। কিন্তু কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা নেই এখানে। ফলে সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ ভিশন নামে একটি এনজিও যৌথভাবে প্রাথমিকভাবে ১০ জন বাগানমালিককে প্রশিক্ষণ দেবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষিতদের মধ্য থেকে কৃষি উদ্যোক্তাও তৈরি হবে। প্রশিক্ষণের পর কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মেশিনারিজও দেবে তারা।