গণবাণী ডট কম:
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এক বছর পার হওয়ার আগেই রবিবার (৭ই ফেব্রুয়ারি) থেকে দেশব্যাপী বিশ্ব মহামারি করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯ এর টিকা দেয়ার কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, সারাদেশের ১ হাজারেরও বেশি হাসপাতালে এই টিকা কার্যক্রম চলবে। এজন্য কাজ করবে মোট ২ হাজার ৪০০টি দল।
এ লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ইতিমধ্যেই ঢাকার জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির স্টোর থেকে টিকার ডোজ কোল্ড বক্সে সংরক্ষণ করে ৬৪টি জেলার বিভিন্ন কেন্দ্র এবং প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং দেশের ৬৪ টি জেলায় ইতিমধ্যেই টিকা পৌঁছে গেছে। তবে টিকা নেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচার প্রচারণা সত্ত্বেও টিকার বিষয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আশা ব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তারা অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন যে, টিকা দেওয়া শুরু হলে মানুষের মধ্যে উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে এবং টিকা নিতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন করোনা মহামারি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় টিকা নেয়া। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে রোববার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি টিকা নেবেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এর আগে টিকা সংরক্ষণ, টিকা দেয়া, টিকা কেন্দ্র পরিচালনা, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ সব বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা ইয়াসমিন জানান, রোববার সকাল থেকে টিকা দেয়া শুরু করার সব প্রস্তুতি নেয়ার পাশাপাশি টিকার ব্যাপারে মানুষকে আগ্রহী করতে তারা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
“আমরা সাড়ে তিন হাজার ডোজ টিকা পেয়েছি। টিকা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণের সক্ষমতা আমাদের আছে। টিকা দেয়ার পর ৩০ মিনিট অবজারভেশনে রাখতে হয়। সেই ব্যবস্থাও আমাদের আছে। প্রস্তুতির ঘাটতি নেই। আমাদের লক্ষ্য রোববার অন্তত ১০০ জনকে টিকা দেয়া।”
উপজেলার ৫৫ বছরের বেশি যাদের বয়স তাদেরকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে এলাকায় মাইকিং করার পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার থেকে ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে সব ব্যক্তিদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টিকা নিতে আগ্রহীদের ওয়েবসাইটে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অর্থাৎ নাম, ঠিকানা, বয়স, পেশা, শারীরিক পরিস্থিতি, জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বর এবং ফোন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
কারণ নিবন্ধন ছাড়া টিকা দেয়া যাবে না।
বিভিন্ন কারণে যারা অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারছেন না তাদের জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে তথ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে স্পট রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে, স্পট রেজিস্ট্রেশন যেদিন হবে, সেদিনই টিকা দেয়া যাবে না। তাদেরকে নতুন আরেকটি তারিখ দেয়া হবে।
শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৮ হাজারের বেশি মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছে, এছাড়া আরও অনেক মানুষ স্পট রেজিস্ট্রেশন করেছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম।
যারা অনলাইন নিবন্ধন করেও টিকার তারিখ ও কেন্দ্রের বিষয়ে এসএমএস পাননি তারা শনিবার রাতের মধ্যেই মেসেজ পেয়ে যাবেন এবং কালকে না হলেও তারা অন্য যেকোনো দিন টিকা দিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার ঢাকার কয়েকটি কেন্দ্রের প্রস্তুতি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে কয়েকটি হাসপাতালের ঘাটতির চিত্র উঠে আসে।
মি. আলম বলেন, “মোটামুটি সব কেন্দ্রেই প্রস্তুতি ভালো আছে। তবে কিছু ছোট ছোট কেন্দ্রে খানিকটা প্রস্তুতির অভাব আছে। এটা সকাল বেলার কথা। আশা করি আমরা আজকের মধ্যে সেটা সম্পন্ন করতে পারবো। কোন কেন্দ্রে সমস্যা থাকলে আমরা চেষ্টা করবো এখান থেকে সমাধান করতে।”
রবিবার সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথমে টিকা দেবেন বলে জানা গেছে। এরপর প্রধান বিচারপতি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী, জন প্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর মতো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও টিকা নেবেন বলে জানা গেছে।
এরপর সম্মুখ-সারির বিভিন্ন পেশার মানুষ অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা এবং যাদের বয়স ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে তাদেরকে বিনামূল্যে টিকা দেয়া হবে। এভাবে একদিনে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি টিকা দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত টিকা কার্যক্রম চলবে।
এই টিকা কর্মসূচি সফল করতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ।
প্রথমত, কাদেরকে কখন কিভাবে টিকা দেয়া হবে এর পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে করতে হবে যেন টিকা কর্মসূচির ওই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়।
দ্বিতীয়ত, শহর, জেলা, উপজেলা, গ্রাম প্রতিটি পর্যায়ে টিকা নেয়ার ব্যাপারে এমনভাবে প্রচারণা চালাতে হবে যেন সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার সবাই টিকা দিতে চান এবং খুব সহজেই টিকা পান।
তৃতীয়ত, নিবন্ধন পদ্ধতিটি অনেক সহজ করতে হবে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিবন্ধনের ঝুঁকি আছে। কারণ সবার কাছে সেই সেবা পৌঁছানো যাবে না।
এজন্য প্রান্তিক মানুষ, অক্ষর-জ্ঞান নেই, যাদের কাছে স্মার্টফোন নেই তাদেরকে নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিবন্ধন করা উচিত, যাতে কেউ বাদ না পড়ে। শহরে এই কাজটি স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে করা যেতে পারে বলে মি.আহমেদ পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, মানুষ যেন সহজেই টিকা পায় এজন্য টিকা কেন্দ্র বাড়াতে হবে।
এছাড়া, টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা সেটা নজরে রাখতে হবে। কারও কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নাহলে এ থেকে গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা থাকবে বলে জানিয়েছেন মি.আহমেদ।
প্রতিটি কেন্দ্রে যথাযথ তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ নিশ্চিত করাও জরুরি বলে তিনি জানান।
তবে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা যে তাপমাত্রায় সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, এই তাপমাত্রায় সংরক্ষণের সক্ষমতা সারা বাংলাদেশে আছে বলে জানান মি. আহমেদ।
তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ যেন নিরবচ্ছিন্ন হয় সেদিকটায় তিনি নজর দিতে বলেছেন।
গত ২৭শে জানুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে এক ডোজ টিকা দেয়ার মাধ্যমে এই টিকা কর্মসূচি শুরু হয়। ওইদিন মোট ২৬ জনকে টিকা দিয়ে হয়েছিল।
পরদিন পাঁচ শতাধিক ফ্রন্টলাইনারকে এই টিকা দেয়া হয়।
ওই দুই দিনে যে ৫৬৭ জন টিকা নিয়েছিলেন তাদের কারও মধ্যে গুরুতর কোন উপসর্গ দেখা না দেয়ায় এবার দেশব্যাপী শুরু হতে যাচ্ছে এই টিকা কার্যক্রম।
www.surokkha.gov.bd - এই ওয়েব পোর্টালে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন।
নিবন্ধন সম্পন্ন হলে মোবাইলে SMS এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনের তারিখ ও কেন্দ্র জানিয়ে দেয়া হবে। অথবা ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে কেন্দ্রে গেলে নিবন্ধন করা যাবে।
নিবন্ধনের ভিত্তিতে কেউ টিকা দেয়ার পর তাকে একটি কার্ডে পরবর্তী ডোজের সময় ও তারিখ লিখে দেয়া হবে।
প্রথমটি নেয়ার চার থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। নাহলে প্রথম ডোজ অপচয় হয়ে যাবে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে দেরী না করে প্রথম ডোজের চার সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয় ডোজ নিতে।
গত মাসেই ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটে উৎপাদিত ব্রিটেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ৭০ লাখ ডোজের চালান বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়।
এরমধ্যে ৫০ লাখ ডোজ বাংলাদেশের কেনা, বাকি ২০ লাখ উপহার হিসেবে পাওয়া।
ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৫ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যেন প্রথম চালানের টিকা যারা নেবেন, তাদের সবার দুই ডোজ সম্পন্ন করা যায়।
তবে প্রতি মাসে ভারত থেকে ৫০ লাখ করে জুন মাসের মধ্যে আরও আড়াই কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে। খবর : বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা।