গণবাণী ডট কম:
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী-কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহের যাবতীয় প্রয়াস, কৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাটাই আবার তৃণমূলের হাতেই যাচ্ছে। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রচেষ্টা সত্বেও বিপুল ব্যবধানে বিজয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পরপর তৃতীয়বারের মত সরকার গড়তে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের তৃণমূল কংগ্রেস।
পশ্চিম বঙ্গে খেলা সত্যিই হয়েছে। খেলার ফলাফল করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ সামলানোর ব্যাপারে ভারতের যে বিপর্যয়কর অবস্থা, নির্বাচনী খেলায়ও তেমনি বিপর্যয় হয়েছে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে, পঞ্চাশ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছে তৃণমূল। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে যা ভোট পেয়েছিল, এবার বিজেপির বাক্সে তা থেকে ৪ শতাংশ কমে হয়েছে ৩৬ শতাংশের মতো ভোট জমা পড়েছে। ফলে মেরুকরণের চেষ্টা, প্রায় সব রাজ্য থেকে নেতাদের উড়িয়ে এনে ভোটের দায়িত্ব দেয়া, মহামারি করোনাকে উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে দিয়ে ৩০টি জনসভা করানো, হামলা, কেন্দ্র দখল, গুলি বর্ষণ কোনো কিছুই কাজে আসেনি। বাংলার মেয়ে দিদির উপরেই ভরসা রেখেছে পশ্চিমবঙ্গ অসাম্প্রদায়িক জনগণ।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ২০৭টি কেন্দ্রে এগিয়ে, বিজেপি ৭৭টি কেন্দ্রে এবং বাম জোট মাত্র দুইটি কেন্দ্রে এগিয়ে। এখনো কয়েকটি রাউন্ডের গণনা বাকি। তবে প্রায় অর্ধেকের বেশি রাউন্ডের গণনা হয়ে গেছে।নাটকীয় কোনো বদল না হলে তৃণমূল কংগ্রেস আবার সরকার গঠন করতে চলেছে।
১২ রাউন্ডের গণনার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৪ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে।
তৃণমূল প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিজেপি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। কংগ্রেস আড়াই ও সিপিএম সাড়ে ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
তৃমমূল কংগ্রেস নেতাকর্মীরা এখন থেকেই জয় পালন করতে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় শুরু হয়েছে সবুজ আবির খেলা। করোনার কড়াকড়ি না মেনে তারা দলের এই অসাধারণ জয় পালন করতে শুরু করেছেন।
কলকাতায় তৃণমূলের মিডিয়া সেন্টার সমর্থকদের ভীড়ে সরগরম থাকলেও বিজেপির নির্বাচনী অফিস করছিল খাঁ খাঁ।
আজ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও তামিলনাড়ু, আসাম, কেরালা ও পন্ডিচেরিতে ভোট গণনা ও ফলাফল দেয়া হলেও সবার নজর পশ্চিমবঙ্গের দিকে। মূল লড়াই বিজেপি ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে। সকাল থেকে চলছে ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ।
গত ২৭শে মার্চ থেকে ২৯শে এপ্রিল পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হয়েছে ২৯২টি আসনে। মোট ২৯৪টি আসনে ভোট হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে দু’জন প্রার্থী মারা যাওয়ায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ২৯২টি আসনে।
নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের কাছে বড় ধাক্কার কারণ, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে একশ আসনও ছুঁতে পারবে না বলে প্রশান্ত কিশোর বা পিকে যে দাবি করেছিলেন, তা দিরি সাদা শাড়ির আঁচলে ঢেকে যাওয়ার পথে। দক্ষিণবঙ্গে প্রায় একচেটিয়াভাবে জিতছে তৃণমূল। উত্তরবঙ্গও তাদের হতাশ করেছে। যে সব আসন তারা জিতবে ভেবেছিল, তা তারা পায়নি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচনে যেই মাত্রার লড়াই দেখা গেছে, তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। করোনা মহামারির মধ্যেও নির্বাচনের আগে জনসভা ও রোড শো করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির বড় বড় নেতারা। ভাষণ দিয়েছেন অন্তত ৫০টি জনসভায়।
করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ সামলানোর ব্যাপারে যে বিপর্যয়কর ব্যর্থতা দেখানো হয়েছে, তার জেরে নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহের আরও যেসব সভা করার কথা ছিল সেগুলি শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। তবে রাজ্যে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন বিজেপি প্রেসিডেন্ট জে. পি. নাড্ডা।
রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল জিতলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, সেটা এখন পর্যন্ত একবারও উল্লেখ করেননি। আজ ভোট গণনা শুরু হওয়ার সময় পর্যন্তও সেটা কেউ জানে না।
ফলে দায়িত্ব হাতে পেলেও সেটা পালনের জন্য তারা একেবারেই প্রস্তুত নয়, বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
যেসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে এবারের নির্বাচনে :
ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম অনেক রাজ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে থেকেছে অনেকদিন থেকেই। কিন্তু বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল যে পশ্চিমবঙ্গে, সে রাজ্যে রাজনীতিতে তা ছিল বিরল। ধর্মের প্রসঙ্গ খুব একটা কোনও দলই নিয়ে আসত না রাজনীতিতে। কিন্তু এবছরই সে রাজ্যের ভোটে কোনও না কোনও ভাবে ধর্ম বেশ প্রকটভাবে উঠে আসছে প্রচারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতৃত্ব যেভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির প্রচারণা ও রাজনীতি চালিয়ে এসেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ব্যাহত হবে। এছাড়া বিজেপি ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে-এমন প্রশ্নও তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা।
উত্তর ও মধ্য ভারতের দল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে বিজাতীয় সংস্কৃতি আমদানি করতে চাইছে, যার সাথে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব ভাষা-শিল্প-মননের মিল নেই, এমনটা অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের।
এই ভোট শুধু যে ২৯৪ জন বিধায়ক বা জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচন করবে তাই নয়। পর্যবেক্ষকরা প্রায় সবাই এক বাক্যে বলছেন রাজ্যের সাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক চরিত্রেও সম্ভবত একটা বড়সড় পরিবর্তনের দিশা দেখাতে পারে এই ভোট।
কেরালায় বাম, আসামে বিজেপি, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে :
কেরলে এগিয়ে বামেরা, আসামে বিজেপি এবং তামিলনাড়ুতে ডিএমকে জোট। পুদুচেরিতে এগিয়ে বিজেপি জোট।
কেরালায় এতদিনের ঐতিহ্য ছিল, একবার বাম এবং অন্যবার কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসে। এবার সেই রীতির বদল হচ্ছে। কারণ, বাম জোট এলডিএফ এগিয়ে ৯৬টি আসনে। কংগ্রেসের জোট ইউডিএফ ৪৪ আসনে এবং বিজেপি কোনো আসনে এগিয়ে নেই। কেরালায় পরপর দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করতে চলেছেন পিনারাই বিজয়ন।
আসামে কংগ্রেস জোটের থেকে এগিয়ে গেছে বিজেপি। তারা এগিয়ে ৭৫ আসনে, কংগ্রেস জোট ৪৮ আসনে এগিয়ে।
তামিলনাড়ুতে আবার ক্ষমতায় আসতে চলেছে ডিএমকে। ডিএমকে জোট ১৪৭ আসনে এবং এআইএডিএমকে জোট ৮৬ আসনে এগিয়ে। পুদুচেরিতে বিজেপি জোট ৮টি ও কংগ্রেস জোট চারটি আসনে এগিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করতে চলেছে। খবর: বিবিসি, ডয়চেভেলে ও অন্যান্য।