গণবাণী ডট কম:
মহামারি করোনার কারণে ৫৪৪ দিন বন্ধ থাকার পর রবিবার গাজীপুরের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের ১৯ দফা নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হয়েছে পাঠদান। শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানাতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ফেটকে নানা রংয়ের বেলুন ও ফুলদিয়ে সাজিয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্র্থী ও অভিভবাক সকলের মধ্যে অজানা ভয় থাকলেও সকলের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। শিক্ষার্থীরাও প্রিয় ক্যাম্পাস ও সহপাঠীদের অনেকদিন পর কাছে পেয়ে খুব খুশী।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস. এম. তরিকুল ইসলাম বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। এসময় যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের পরামর্শ দেন। তিনি গাজীপুর মহানগরীর হাড়িনাল উচ্চ বিদ্যালয় এবং হাড়িনাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে অনুরোধ জানান। এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) অঞ্জন কুমার সরকার উপস্থিত ছিলেন।
রবিবার সকালে সরেজমিন গাজীপুর মেট্রোপলিটন কলেজে দেখা যায়, প্রধান ফটকে কলেজ অধ্যক্ষসহ সকল শিক্ষক সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের স্বাগত জানান। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যালয়ে প্রবেশ কালে থার্মার মেশিন দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এরপর সকলের হাত স্যানিটাইজার দিয়ে স্যানিটাইজ করে ক্লাশে প্রবেশ করানো হয়। শ্রেণীকক্ষে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে এক বেঞ্চে দুজন করে বসানো হয় তাদের। সকাল ৯টায় সকলে শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করে।
নাফিসা সাদিক হিমেল। সে এবছর গাজীপুর মেট্রোপলিটন কলেজের একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে। করোনার কারণে দীর্ঘ বন্ধের সময়টা বই পড়া, অনলাইনে ক্লাশ, এ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করার পাশাপাশি ঘরবন্দী হয়েই কেটেছে তার। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর করোনার কারণে ক্লাস করার কোনো সুযোগ ছিল না তার। কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর গতকাল রবিবার এই প্রথম সে ক্লাস করার সুযোগ পেল। সুযোগ পেলো তার সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সাথে পরিচিত হবার। এ কারণে সে খুবই উল্লাসিত এবং আনন্দিত। তার প্রত্যাশা করোনা সংক্রমণ যেন আর না বাড়ে।
গাজীপুর মহানগরীর ঐতিহ্যবাহী রানী বিলাসমণি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় গিয়ে দেখা গেল প্রায় একই চিত্র। এখানের সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যালয়ে প্রবেশ কালে থার্মার মেশিন দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এরপর সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ক্লাশে প্রবেশ করানো হয়। স্কুল শুরু হয় এই বিদ্যালয়ে। ঘন্টা বাজানোর পর ক্লাশ শুরু একটি আনুষ্ঠানিকতা রুপ পায়। কোন কক্ষে বেঞ্চ বড় হলে এক বেঞ্চে দুইজন, আর বেঞ্চ একটু ছোট হলে এক বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থী বসতে দেখা গেছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে ছিলো করোনা মোকাবেলায় সচেতনতা মুলক নানান বার্তা। সকল শ্রেণীকক্ষের সামনে ময়লা ফেলার ঝুড়ি, হাত ধোয়ার বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এখানে। শিক্ষার্র্থীদের ঢোকার জন্য একটি গেট ও বের হয়ে যাবার জন্য আলাদা গেট খোলা রাখা হয়েছে।
রানী বিলাসমণি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়র ছাত্র রিফাত। সে এ বছরই এ বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সে জানায়, বন্ধের সময় কাজে লাগাতে পেরেছি। ঘরে থেকে পড়াশোনা করেছে, অনলাইন ক্লাসে যুক্ত থেকেছে এবং নিয়মিত সবগুলো এসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে। স্কুল এখন খুলেছে, তাই পড়াশোনার চাপ সামলে নিতে হবে। সে আরও জানায়, আমি ক্লাস নাইনে থাকার সময়ে স্কুল বন্ধ হয়েছে আর আজকে যখন স্কুল খুলেছে তখন আমি দশম শ্রেণীতে এসএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে পড়াশোনা করছি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বুব শাহিনা বলেন, আজকে ক্লাশ শুরুর প্রথম দিন। দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের কাছে পেয়ে আমার মন আবেগে আপ্লুত। এই সময়ের মধ্যে আমরা অনেকে অনেক প্রিয় জন আত্মীয়-স্বজনকে হারিয়েছি। হয়তো অনেকে করণ আক্রান্ত হয়েছে গেছে নিয়ে সুস্থ হয়েছে। তারপরেও অনেক দিন পর আবার আমরা সকলে একত্রিত, মিলিত হতে পেরেছি এ এক বিরাট পাওয়া। তিনি আরো বলেন, আমরা সরকারী সকল নিয়ম অনুসরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিধি অনুযায়ী ক্লাশ পরিচালনা শুরু হয়েছে। আমরা চাই যাতে কোন শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্থ না হোক। তিনি বলেন, অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে একদিন করে ক্লাশ নেয়া হবে। এজন্য রুটিন প্রকাশ করা হয়েছে।
অনুরূপ চিত্র দেখা গেছে গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানেও সকালে শিক্ষার্থীরা আসার অনেক পূর্বে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তারা হাসিমুখে দীর্ঘ বিরতির পর খোলার প্রথমেদিনে বিদ্যালয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানান। অভিভাবকগণ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ নিজেদের সন্তানদের বিদ্যালয় পৌঁছে দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশী। একটি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ৭টি কক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসানো হয়েছে। এক বেঞ্চে একজন করে বসেছে। তারপর ঘন্টা বাজিয়ে, মাস্ক নিশ্চিত করে, হাত ধুয়ে এবং সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করে শ্রেণী কক্ষে পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। শুরু হয় আনুষ্ঠানিক পাঠদান কার্যক্রম। প্রথমদিনে বইয়ের উপরে তেমন কোনো গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়নি, এদিন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের বিগত সময়ে কিভাবে কেটেছে পরিবর্তিত করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের কিভাবে প্রস্তুত করবে ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পায়।
এ বিদ্যালয়ে খোলার প্রথম দিনের কার্যক্রম দেখার ও তদারক করার জন্য উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামীম আহমেদ।
এ বিদ্যালয়ের বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী শামামা জানায়, স্কুল বন্ধের আগে সে ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীতে। বন্ধ থাকার পর আজ ক্সুলে এসে সে তৃতীয় শ্রেণীতে বসেছে। পুরনো সহপাঠীদের পেয়ে সে খুব খুশী।
এসময় গাজীপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, সরকার সময়োপযোগী ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আমাদের সকলের উচিত সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যালয় আসা, পাঠদান কার্যক্রম অংশগ্রহণ করা এবং বিদ্যালয় থেকে ঘরে ফেরার বিষয়টি যেন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করা।