গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর মহানগরীর মানিকের টেক এলাকায় একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে সুস্থ মানুষকে রোগী সাজিয়ে আটকে রাখা, ভর্তিকৃত রোগীদের নির্যাতন করাসহ নানা অভিযোগে নিরাময় কেন্দ্রটিতে অভিযান চালিয়েছে র্যাব। গতকাল মঙ্গলবার র্যা বের অভিযানের সময় কেন্দ্রটি থেকে ৪২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় কেন্দ্রের মালিকসহ ৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে র্যাব।
মঙ্গলবার বিকেলে র্যাব-১ এর সদস্যরা ওই প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান পরিচালনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এসব কথা বলেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদেরকে শারিরীক, মানসিক নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। একইভাবে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে যাতে তাদের শরিরীকভাবে নির্যাতন তথা ঝুলিয়ে নির্যাতনের কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানটি পরিচালিত হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, তাৎক্ষনিকভাবে আসায় আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। নিরাময়ের জন্য মাদক নিরাময় অধিদপ্তর কর্তৃক যে ক্রাইটেরিয়া দেয়া আছে সেগুলো এখানে অনুপস্থিত। যারা এখানকার সেবা গ্রহীতা ছিল তাদেরকে যে খাবার দেয়া হতো তার মান অত্যন্ত খারাপ ছিল। এখানে সর্বদা চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না। এরকম বেশ কিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে।
এখানকার মালিকসহ যে ৫ জন কর্মচারী রয়েছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। নিরাময় কেন্দ্রটিতে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল কম ছিল। যখন এ কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল তখন অনুমোদনহীন অবস্থায় চালু করা করা হয়েছিল। মাদক নিরাময় অধিদপ্তর কর্তৃক কেন্দ্রটি যখনই পর্যবেক্ষণ করা হয় তখনই কেবল প্রয়োজনী জিনিস দেখানো হয়েছিল। পরে সেগুলো তাদের ইচ্ছামতো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যে পরিমাণ বেড থাকার কথা তা নেই। তুলনামূলক বেশি রোগী রাখা হয়েছে, ভাল বাসস্থান নেই।
তিনি বলেন, এটা একটা মাদক নিরাময় কেন্দ্র হলেও যারা পরিচালনা করছেন আসলে তারা মালিকসহ সকলেই মাদকাসক্ত হিসেবে আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। অভিযানের সময় ৪২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এখানে ২০ জনের জায়গায় ২৮ জনকে চিকিৎসাধীন পাওয়া গেছে।
২০০৯ সাল থেকে কেন্দ্রটি পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানে একজন রোগী পাওয়া গেছে যিনি তিন বছর যাবত এখানে রয়েছেন। মাদকাসক্ত নয় এমন সুস্থ ব্যাক্তিদেরও জোর করে এখানে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময় মারধোরও করা হয়েছে। যাদের শরীরে জখমের দাগ পাওয়া গেছে এমন সাতজনকে পরীক্ষার জন্য চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। সেবাগ্রহীতা যারা তাদের এসব কর্মকান্ড নিয়ে কথা বলতে চেয়েছে তাদেরকে তাদের পাািলত সন্ত্রাসী দিয়ে বেঁধে পেটানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখানে ট্রিটমেন্টের প্যাটার্ন যেভাবে ছিল সেভাবে ট্রিটমেন্ট করা হয়নি। এখানে সেবাগ্রহীতাদের স্বজনেরাও রয়েছেন। ভাল ট্রিটমেন্টের জন্য সেবাগ্রহীতাদের অনেককেই তারা নিয়ে গেছেন।
২৮ দিন পর একজন সেবাগ্রহীতার রেজাল্ট দিতে হয়। তাছাড়া তিন মাস পর পর রেজাল্ট দিতে হয়, সেগুলো আমরা অনুপস্থিত পেয়েছি। সার্বক্ষণিক কোনো ডাক্তার এখানে ছিল না। এই কার্যক্রম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ কেন্দ্রটি (সাসপেন্ড) বন্ধ করেছেন। ভুক্তভোগী, রোগীদের অন্য নিরাময়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের স্বজনদের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার একজন অভিনেতা মাদকাসক্ত নয় তাকেও আমরা এখানে পেয়েছি। তাকেও মেডিকেল টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। তাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে সে ব্যাপারেও আমরা পুরোপুারি তথ্য পাব। আজ রাতেই তা জানতে পারব। মাদক নরিমাময় এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে কর্মকর্তাগণও আমাদের অভিযানে যুক্ত ছিলেন।
তিনি আরো জানান বৈধ কাগজপত্র না থাকায় এবং লিখিত অভিযোগের কারণে মাদক নিরাময় কেন্দ্র টি সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে উদ্ধার হওয়া সমস্ত রোগীদের স্বজনদের খবর দেওয়া হয়েছে যারা যে সমস্ত স্বজনেরা নিজেদের রোগীকে নিজের হেফাজতে নিতে চায় সে সময় রোগীকে স্বজনদের হেফাজতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং যে সমস্ত রোগীর স্বজনরা আসতে পারেননি অথবা রোগীকে নিতে চান না তাদেরকে গাজীপুর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এর তত্ত্বাবধানে ঢাকার কোন উন্নত মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই কেন্দ্রের নিবাসী ছিল কিশোরগঞ্জের ছেলে মেহেদী হাসান। সে এই কেন্দ্রে প্রায় নয় মাস যাবত ভর্তি রয়েছে। তিনি জানান কেন্দ্রটিতে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে কোন ফ্যাসিলিটিজ নেই নেই কোন ডাক্তার অথবা কাউন্সিলিং করার মত কোন ব্যক্তি এখানে কোন বিষয়ের প্রতিবাদ করলে চরমভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে এবং সব সময় তারা নানাভাবে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে থাকে। কিন্তু এসব কথা স্বজনদের নিকট প্রকাশ করা যায় না কারণ স্বজনরা যখন সাক্ষাৎ করতে আসে তখন কেন্দ্রের লোকজন উপস্থিত থাকে ফলে প্রকৃত সত্য ঘটনা স্বজনদের নিকট বলা সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
এই কেন্দ্রের নিবাসী গাজীপুর মহানগরীর পোড়াবাড়ি এলাকার, মনজুর হোসেন এর মা হেলেনা আক্তার জানান তার ছেলে 2 মাস 10 দিন আগে এখানে ভর্তি করা হয়েছিল ভর্তির পর ছেলের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়না। এখানে আসলে তারা অনেক সময় নানান অজুহাত দেখিয়ে সাক্ষাৎ করতে দিত না। আজকের অভিযানের খবর পেয়ে তিনি ছেলেকে ফেরত নিতে এসেছেন। তিনি জানান, আমার সন্তান এক সপ্তাহ আগে আমি যখন দেখা করতে এসেছিলাম। তখন আমার সন্তান আমার হাতে-পায়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল যেন আমি তাকে এখান থেকে নিয়ে যাই কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি। আজ যখন আমাকে ফোন করা হল তখন আমি আমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব তুমি আমাকে আগে বলনি কেন? তখন আমার ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বলে কেন মা আমি যখন তোমার পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছি তখন তুমি বুঝতে পারো নাই এখানে আমার উপর নির্যাতন করা হচ্ছিল এসময় এই অসহায় মাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়।
একই রকম অভিযোগ করেছেন গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার দমদমা এলাকার রায়হান (২০) এর বড় বোন তানিয়া বেগম। তিনি বলেন হঠাৎ আমার ভাই খারাপ লোকজনের সাথে চলাফেরা করতে শুরু করল বাড়িতে অযথা ঝগড়াঝাটি মারামারি করতে লাগল এবং ২০ টাকার জন্য আমাদেরকে হুমকি দিয়ে ঘরে ভয়াবহ রকমের অশান্তির পরিবেশ তৈরী করে। ফলে আমরা খোঁজ নিয়ে বুঝতে পারলাম যে সে মাদকাসক্ত তখন আমরা তাকে এই ভাওয়াল নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করেছি। ভর্তির পর তার সাথে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারতাম না। দেখা করতে আসলে কেন্দ্রের লোকজনের সামনে আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হতো সে কখনোই আমাদের সামনে মন খুলে কথা বলতে পারতোনা আজকের অভিযানের খবর পেয়ে আমি আমার ভাইকে ফেরত নিতে এসেছি।