গণবাণী ডট কম:
নদীকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশ সৃস্টি হয়েছে। এক সময় এই ব-দ্বীপ অঞ্চল তথা অধুনা বাংলাদেকে আখ্যায়িত করা হতো ‘স্বর্গতুল্য বঙ্গভূমি’ হিসেবে। আর বাংলাদেশের আর্শিবাদ হচ্ছে অসংখ্য নদ-নদী। আর এই নদ-নদীই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধংসের কবল থেকে রক্ষা করে আসছে। বর্তমানে নদীকে কেন্দ্র করে পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। যেতে হবে ব-দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। নদীগুলোর গতি-প্রকৃতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রন করা যাবেনা। ভাঙন কবলিত এলাকায় পরিকল্পিত উপায়ে তৈরি করতে হবে বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ। এ ছাড়া করতে হবে ব্যাপক বনায়ন। চিংড়ি চাষের জন্য ভূ-ভাগে লবন পানি টেনে আনাকে রুখতে হবে। অপরদিকে নদী ভাঙন, লবনাক্ততাসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জনগণকে রক্ষায় নিতে হবে টেকসই পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে শত শত বছর ধরে ওই অঞ্চলে টিকে থাকা মানুষের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই আবার দেখা মিলবে উপকূলের সেই সম্ভাবনার বাতিঘরের।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় শুক্র ও শনিবার দুই দিনের ‘উপকূলীয় নদী সম্মেলনে’ এসব কথা বলেন অংশগ্রহন কারি আলোচকরা।
‘বাঁচাও উপকূল, ফেরাও সম্ভাবনা’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন, ওয়াটার্স কিপার্স বাংলাদেশ, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, জয়েন্ট কো-অপারেশন প্রোগ্রাম বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, পরিবেশ ও নদী রক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, ড্রিম প্লানেট এবং রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করেন।
এর আগে ২০১৯ সালে পার্বত্য অঞ্চলের নদ-নদী নিয়ে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে (এনআরসিসি) নিয়ে বান্দরবান জেলায় ‘পার্বত্য নদী সম্মেলনের আয়োজন করে। উপকূলীয় নদ-নদী নিয়ে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় এ বছর প্রথম বারের মতো ‘উপকূলীয় নদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে স্থানীয় পরিবেশবিদ মেজবাহ উদ্দিন মাননু নিশ্চিত করেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে ‘উপকূলের নদ-নদী ও জনজীবন ঃ জলবায়ু পরিবর্তন ও লবনাক্ততার প্রভাব’ বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থপান করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো. মনির হোসেন চৌধুরী।
তিনি তাঁর মূল প্রবন্ধে উপস্থাপন করে বলেন, ‘নদীর গতিপথের অবস্থান ও নদীর সাথে সংযোগকারী উপ শাখা নদী, খাল, বিল, হাওড়, বাওড় ও নদীর অববাহিকা ভিত্তিক তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। এ ছাড়া নদীর পানি ও পরিবেশের অবস্থা নিরূপনে দূষণের উৎস, ধরণ মাত্রা নির্ধারণ করা, নদীর ভূমি দখল, নদীর ওপর ও তীরবর্তী সব অবকাঠামো অপসারণ করা এবং ভবিষ্যতে নদী দখল করে যাতে নতুন করে অবকাঠামো নির্মিত না হয় নে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। প্রধান অতিথি হিসেবে অনলাইনে যুক্ত হয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের জেষ্ঠ্য সচিব কবির বিন আনোয়ার। এ সময় তিনি বলেন, উপকূলের সকল নদী রক্ষার জন্য সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ পরিবেশবাদী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে একযোগে কাজ করতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী রক্ষায় শতভাগ আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রী নদীকে মানবদেহের শিরা-উপশিরার সাথে তুলনা করেছেন। আমরাও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশকে গড়ার জন্য উপকূলের নদ-নদী বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়াও সামুদ্রিক জীব-বৈচিত্রের জন্য উপকূলীয় নদীরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনকারী খাতগুলোর মধ্যে চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি উৎপাদন, শিল্পায়ন হচ্ছে উপকূলীয় নদীকে কেন্দ্র করে। সুতরাং মূল ভূখ›ডকে গড়ার জন্য উপকূলের নদ-নদীকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। উপকূলীয় নদীগুলো লবন ও সাধু পানির মিশ্রন এবং উজান থেকে বাহিত প্রচুর পুষ্টি উপাদান বহন করে বিধায় মাছের জন্য উপযুক্ত প্রজনন পরিবেশ এবং বিচরণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। সর্বোপরি বলতে চাই, আমাদের আবহাওয়াগত পরিবর্তন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে জনমানবকে রক্ষা করতে হলে উপকূলীয় নদ-নদীকে সংরক্ষন করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলার আহবায়ক ও পশুর নদীর ওয়াটারকিপার্স নুর আলম শেখ বলেন, ‘পশুর নদীকে বলা হয় সুন্দরবনের প্রাণ। পশুর নদীসহ সুন্দরবনের পাশ্ববর্তী সব নদীকে মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ বেশ কিছু দিন ধরে এক শ্রেণির জেলেসহ মানুষজন এসব নদীর পানিতে বিষ ঢেলে মাছ ধরে থাকে। এ মাছ যাঁরা খায়, তাঁরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। তা ছাড়া বিষযুক্ত পানি বিভিন্ন নদ-নদীতে গড়িয়ে নামছে। নদ-নদীর পানি ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকার মানুষজন রোগাক্রান্ত হচ্ছে। এক কথায় উপকূলের বিরাট অংশের মানুষ হুমকির মুখে পড়ছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হবে। নদীর পাশে শিল্প কারখানা, ইট ভাটা এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।’
পরিবেশ ও নদী রক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এইচ এম সুমন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৮টি জেলার ৫৩ শতাংশ এলাকা লবনাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। লবনাক্ততার কারণে শুধু যে কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে তা নয়, মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে। পাশাপাশি মানুষের হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। আইসিডিডিআরবি এ নিয়ে এক গবেষণা প্রকাশ করেছে। এসব নিয়ে এখনও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নিলে উপকূল বাঁচবেনা, মানুষও বাঁচবেনা।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কলাপাড়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ্ উদ্দিন মাননু বলেন, ‘নদী সম্পর্কিত তথ্য আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেনা। নদীর ইতিহাস, তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করলে নতুন প্রজন্ম নদী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে।’
বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০ নিয়ে একটি কারিগরী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী ও কর্মকর্তারা অংশগ্রহন করেন।