গণবাণী ডট কম:
বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের যে নেতা, সেই মিখাইল গর্বাচেভ ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন।
রাশিয়ার সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, সাবেক এই সোভিয়েত নেতা স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন।
তাস, আরআইএ নভোস্টি এবং ইন্টারফ্যাক্স রাশিয়ার সেন্ট্রাল ক্লিনিকাল হাসপাতালের উদ্ধৃতি দিয়ে এ খবর জানিয়েছে। এর আগে গর্বাচেভের অফিস থেকে জানানো হয়েছিল তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
রাশিয়ার সেন্ট্রাল ক্লিনিকাল হাসপাতাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘গুরুতর ও দীর্ঘকালীন অসুখে ভুগে মিখাইল গর্বাচেভ আজ মারা গেলেন। ’
গত জুন মাসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, কিডনির জটিলতায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কি কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনো ঘোষণা করা হয়নি।
রাশিয়ার তাস বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, তাকে মস্কোর নভোদেভিচি কবরস্থানে তার স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত করা হবে, যেখানে অনেক নামী রাশিয়ানের কবর রয়েছে।
রুশ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্স সাবেক মিখাইল গর্বাচেভের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
মিখাইল গর্বাচেভের মৃত্যুতে তার প্রতি সারা বিশ্ব থেকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ”তিনি ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিলেন।”
”মিখাইল গর্বাচেভ ব্যতিক্রমী একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তার মৃত্যুতে বিশ্ব একজন নেতা হারালো যিনি শান্তির জন্য একজন অক্লান্ত সমর্থক ছিলেন,” বলেছেন মি. গুতেরেস।
আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন মিখাইল গর্বাচেভকে বিশ্বস্ত ও সম্মানিত নেতা হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন। বলেন, সাবেক এই নেতা মুক্ত ইউরোপের দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
১৯৮৪ সালে মিখাইল আন্দ্রোপভের মৃত্যু হলে গর্বাচেভকেই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বা সর্বপ্রধানের পদে ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু সেবার সেই পদে নির্বাচিত হন কনস্তানতিন চের্নেনকো। ১৯৮৫ সালে তিনি মারা গেলে ওইসোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন গর্বাচেভ। সে সময় ৫৪ বছরের গর্বাচেভ ছিলেন পার্টির প্রতাপশালী পলিটব্যুরোর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আর তিনিই রুশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক, যার জন্ম হয়েছিল রুশ বিপ্লবের পর।
তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত নামে উদারীকরণের দুই কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তার মূল নীতি গ্লাসনস্তের (উন্মুক্ত হওয়া) ফলে দেশের জনগণ সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ পায়, যা অতীতে চিন্তাও করা যেতো না।
কিন্তু এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চিন্তার উদ্ভব ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে ইউনিয়নের পতন ঘটে। সমালোচকরা বলেন, এক সময়ের কমিউনিস্ট নেতা গর্বাচেভের হাত দিয়েই সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। ওই পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে তখন স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। তাই অনেকের কাছে তিনি নন্দিত, আবার অনেকের কাছে তিনি নিন্দিতও।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, পরাশক্তি থেকে রাশিয়াকে দুর্দশাগ্রস্ত দেশের কাতারে নিয়ে আসার জন্য অনেক রুশ এখনও গর্বাচেভকে ক্ষমা করতে পারেন না। কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দেশ হলো বর্তমান রাশিয়া।
সোভিয়েত পতনের পর নিজেও ক্ষমতা হারান গর্বাচেভ। এরপর পশ্চিমা দেশগুলোতে বক্তৃতা দিয়েই সময় পার করতেন তিনি। ১৯৯৯ সালে স্ত্রী রাইসা গর্বাচেভের মৃত্যুতে অনেকটাই ভেঙে পড়েন।
আন্তর্জাতিকভাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি করেছিলেন। যখন পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর বাসিন্দারা তাদের কম্যুনিস্ট শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে শুরু করে, তিনি সেসব দেশে হস্তক্ষেপ করতে রাজি হননি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৯ সালে চেকস্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরিতে কমিউনিস্টবিরোধী বিক্ষোভ দমনে সোভিয়েত সেনা পাঠাননি।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যানের সঙ্গে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করে স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পথ তৈরির জন্য তার প্রশংসা করেন পশ্চিমারা। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলো তাকে একজন সংস্কারক হিসাবে দেখে। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে গভীর উত্তেজনা ছিল।
পূব-পশ্চিমের সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখার জন্য ১৯৯০ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।
কিন্তু ১৯৯১ সালে যে নতুন রাশিয়ার জন্ম হয়, সেখানে রাজনীতিক হিসাবে তার তেমন ভূমিকা ছিল না। তিনি বরং শিক্ষা এবং মানবিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি একবার রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র ০.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
গর্বাচেভ ছিলেন বেশ ফ্যাশনদুরস্ত। এ কারণে তাকে পূর্বসূরিদের সঙ্গে মেলানো যেত না। আর তার স্ত্রী রাইসার চালচলন ছিল অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডিদের মতো।
এক সময় রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কঠোর সমালোচক ছিলেন গর্বাচেভ। তবে ২০১৪ সালে পুতিনের নির্দেশে যখন ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া, তখন তার পক্ষেই ছিলেন তিনি। এরপর গত বছর গর্বাচভের ৯০তম জন্মদিনে তার প্রশংসা করেন পুতিন।