গাজীপুর প্রতিনিধি:
বন,খালবিল ও নদীনালার অবৈধ দখল ও ভরাট, নদ-নদী ও জলাশয়ে অবাধে অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য ও কঠিন বর্জ্য অপসারণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বায়ূদূষণ, কৃষি জমির অপব্যবহার, সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা, বনের জমিতে কল কারখানা, বসতবাড়ি, পার্ক নির্মাণ, শাল-গজারীসহ প্রাকৃতিক বনজ গাছ কেটে ভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণসহ নানা কারণে পরিবেশ দূষণে গাজীপুর বসবাসের অনুপযোগি শহরে পরিণত হচ্ছে। ভয়াবহ এ দূষণের হাত থেকে গাজীপুরকে বাঁচাতে না পারলে আগামী প্রজন্মকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। জেলার একটি জলাশয়ও দূষণমুক্ত নেই। পরিবেশ দুষণে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত গাজীপুরকে বাঁচাতে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারী ও বেসরকারী সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সাথে জনসচেতনতা ও সব শ্রেণী পেশার মানুষকে পরিবেশ দূষণরোধে এগিয়ে আসতে হবে।
সোমবার পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর : উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক গণশুনানীতে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেছেন পরিবেশবিদ, প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ ও সাধারণ নাগরীকবৃন্দ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, ক্যাথলিক এজেন্সি ফর ওভারসিস ডেভেলপমেন্ট ও সুইডেন স্ভেরিজ যৌথভাবে এ গণশুনানির আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান।
গাজীপুর মহাগরীর রাজবাড়ী রোডে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার অডিটরিয়ামে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) অনুষ্ঠিত গণশুনানীতে প্রধান অতিথি ছিলেন, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গাজীপুরের শিল্প দূষণ, নদী-খাল-জলাশয়ের বর্তমান অবস্থা, বন দখল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জনদুর্ভোগ বিষয়ক উপস্থাপনা পেশ করেন, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অসীম বিভাকর।
আলোচনায় অংশ নেন, গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য এডভোকেট রীনা পারভীন, ভাষা শহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো: মনির হোসেন প্রমূখ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই গাজীপুরের পরিবেশ সমস্যার উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে পরিবেশ দূষণে ভূক্তভোগী জনগোষ্ঠির অভিযোগ উপস্থাপন ও মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ, ছাত্র-ছাত্রী, পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার বিভিন্ন পেশার লোকজন, সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ। তাঁরা গাজীপুরের পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলেন, এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় একশ্রেণীর দখলদাররা বেদখল করে আইন লংঘন করে নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ও উন্মুক্ত জলাশয়ে শিল্প বর্জ্য ফেলার কারণে গাজীপুরের সব নদ-নদী ভয়বহ দূষণের শিকার হয়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্বক ক্ষতিসাধন করছে। জলজ প্রাণী, মৎস্য শুন্য হয়ে পড়েছে। ফলে নদী জলাশয় কেন্দ্রীক অনেক জনগোষ্ঠি তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে। অনেকে নিজস্ব বাসস্থান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। দখলের কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে মোগড়খাল নামক গাজীপুরের প্রধান একটি খালসহ অন্যান্য অনেক খাল, লবনদহ নদী, বালু নদী, তুরাগ নদ, বানার নদ প্রভৃতি। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে অবক্ষয়িত হচ্ছে মাটি, দূষিত হচ্ছে পানি ও বাতাস। হারিয়ে যাচ্ছে চাষযোগ্য ফসলী জমি ও বনভূমি। এতে গাজীপুরের পরিবেশ, জনস্বাস্থ ও জনজীবন ভয়ংকর পরিনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে । এ থেকে গাজীপুরকে বাঁচাতে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে গাজীপুরের পরিবেশ দূষনরোধে কতিপয় দাবী উত্থাপন করা হয়। এসব দাবীর মধ্যে রয়েছে, নদনদী, খাল, জলাশয়ের সীমানা চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা এবং দখল ও দূষণরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, শিল্পকারখানাতে ইটিপি প্ল্যান্ট বসানো ও তা চালু রাখার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নতুন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের জনমত গ্রহণপূর্বক পরিবেশগত প্রভাব নিরূপন, শহরের বর্জ্য সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা, কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর শিল্পকারখানার জন্য “গ্রীণ ট্যাক্স” আদায়ের ব্যবস্থা করা, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারী সংস্থার সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা, দেশে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা, কৃষিজমি দখল ও বিরুদ্ধ ব্যবহার রোধ করে কৃষিজমি সুরক্ষা প্রদান, সংবিধান, আইন ও আদালতের আদেশ মেনে বনভূমির যথাযথ সংরক্ষণ এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও বিদ্যমান নিয়মনীতি কঠোরভাবে প্রতিপালন করা।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো: মনির হোসেন হোসেন বলেন,আমরা বিভিন্ন সময়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য চেয়ে পাইনা। তিনি পরিবেশ রক্ষায় সকলকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান।
নদী পরিব্রাজক দলের গাজীপুরের সভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, মোগরখালের পাড়ে মাদ্রাসা, মসজিদসহ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। মোগরখালটি ৯টি গ্রামের বুক চিরে প্রবাহিত। খালের দুই পাশে ২০টি গ্রামের উপকারভোগী মানুষ রয়েছেন। হাজার হাজার একর জমি আবাদ হয় খালের পানি দিয়ে। যদিও আমরা এখন আর কৃষি জমি আবাদ করতে পারছি না। অতি সম্প্রতি খালের ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করে খালের প্রবাহ উল্টোদিকে ঘোরানো হয়েছে। ব্রিজটি খালের পানি প্রবাহের দিকে করার অনুরোধ করছি।
রোভারপল্লী ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক আমীর হোসেন বলেন, বন বিভাগের স্থানীয় লোকজনই মনিপুরের বন ধংস করছে। তারা ১৫/২০ ফুট বনের জমি ৫০ থেকে এক লাখ টাকার বিনমিয়ে বাড়ি করার অনুমতি দিচ্ছে। শিল্প মালিক যারা বন দখল করছে, রিসোর্ট পার্ক তৈরী করছে সেসব রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে বন মামলা হয় না। তাদের সংখ্যা খুব কম। মামলার শিকার হচ্ছে এলাকার নিরীহ সাধারণ মানুষ, যারা দখলের প্রতিবাদ করে। এাকার লোকজন দখলের প্রতিবাদ করেন, বাইরে থেকে এসে কেউ বন দখলের প্রতিবাদ করেন না।
বিপাশা আফরিন বলেন, ময়লার কারণে গাজীপুর শহরের শিববাড়ী থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত নাক খুলে শ্বাস নিতে পারেন না শুধুমাত্র ময়লার ভাগাড়েরর জন্য।
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ মৃধা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে খালের পানিতে বিষাক্ত বর্জ্য প্রবাহিত হচ্ছে। তার প্রভাবে গবেষণঅগারের মাছের মধ্যে এমন রোগ হয় যা টেস্ট করে পাওয়া যায় না। অর্গানিক পরিবর্তন করে এমনটি হয়েছে। গরুর জন্য চাষ করা ঘাসের মধ্যে এমন কিছু বিষ দেখা গেছে যা গাভী খাওয়ার পর দুধ পর্যন্ত বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। তিনি পরিবেশ দূষণে এসবের প্রতিকার দাবী করেন।
বাড়ীয়া গ্রামের মোসলেম, উদ্দিন বলেন, বাড়ীয়ার নদী ও খালগুলোর পানি দিয়ে আগে চাষাবাদ করা হতো। পানি বিষাক্ত হওয়ায় এখন ধানের চারা বা যে কোনো ফসলের চারা পঁচে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক মাছগুলো এখন আর চোখেও দেখা যায় না।
সাহাপাড়ার বাসিন্দা কাজী বদরুত আলম মনির বলেন, গাজীপুর শহরের জোড়পুকুর, সিটি করপোরেশন ভবনের উত্তর পাশের পুকুর, ফায়ার সার্ভিস অফিস সংলগ্ন টাঙ্কিরপাড়া পুকুর, কালীবাড়ী পুকুর, রাণী বিলাসমনি পুকুরের মধ্যে বেশ কয়েকটি দখল এবং কিছু মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছে।
জেলে আব্দুল খালেক বলেন, আগে গাজীপুরের জলাশয়গুলো থকে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতাম। এখন এসব জলাশয়ে মাছ পাওয়া যায় না। পেশাও পরিবর্তন করতে পারছি না। খুব দুঃখ কষ্টে দিনাতিপাত করছি।
শুনানীতে বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বণায়নের নামে বনকে দয়াকরে বাগান বানাবেন না। জীবনের জন্য শিল্প প্রয়োজন, তবে তা পরিবেশকে ধ্বংস করে নয়। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য কি রকম দেশ রেখে যেতে চাই। তিনি সকলের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য সমাজ গঠনে প্রচলিত আইন প্রয়োগ করে পরিবেশ রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান শুনানীতে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, জেলায় সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর অনেক দায় রয়েছে। গত ত্রিশ বছরে গাজীপুরে অর্থনৈতিক ট্রান্সফরমেশন হয়েছে। আগে জলাশয়ের যে প্রবাহ খাল বিলে ছিল এখন আর নেই। তাঁর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে দোষীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেছেন। মোগরখালের একটি অংশে ব্যাক্তিগত জায়গা রয়েছে। আমরা সেটি খুলে দিতে পারিনি। একটি গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ২০৬টি পুকুর বেদখল হয়ে গিয়েছিল। সেখানে ইতোমধ্যে আমরা ৮টি পুকুর উদ্ধার করেছি। আমার কাছে এনফোর্স করার মতো সুযোগ রয়েছে কিন্তু সাসটেইন করার মতো বাজেট আমার কাছে নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে মিটিং করে সকল পুকুরগুলোকে একটি প্রকল্পের আওতায় এনে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। জেলা প্রশাসন হাজার হাজার ইস্যু নিয়ে কাজ করছে। সেখানে সাসটেইন করার দায়িত্ব তিনি জনসাধারণকে নেয়ার আহবান জানান। মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া গাজীপুরের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।