গণবাণী ডট কম:
ডিএনএ, ভিসেরা, ফরেনসিকসহ বিভিন্ন রিপোর্ট বা প্রতিবেদন প্রাপ্তিতে বিলম্বের কারনে গাজীপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়েরকৃত ৩৮৩ টি মামলা ঝুলে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে এসব মামলার বাদি-বিবাদী সবাই নানামুখী হয়রাানি ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রীতার শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার বিচার কাজ নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার জন্য ডিএনএসহ বিভিন্ন আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে প্রকৃত আসামিগণকে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে অব্যাহতি প্রদান করা সহজ। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রাপ্তিতে বিলম্বের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে মানুষকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ডিএনএ রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্টসহ নানা কারণে পুলিশ সময় মতো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় অনেক মামলার বিচার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। একই সাথে মাসের পর মাস এসব মামলার বাদি ও আসামিগণ নানাভাবে হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। সময়ের আবেদন মঞ্জুর এবং পুনরায় তারিখ ধার্য করাসহ নানা কারণে বিজ্ঞ আদালতের সময় নষ্ট হচ্ছে।
গাজীপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট এবিএম আফফান বলেন, ডিএনএ রিপোর্ট বা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সময়মত না পাওয়ার কারণসহ নানা কারণে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দেরী হয়। এতে করে বিচার প্রার্থী এবং আসামি নানারকম ভোগান্তি এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
জানা গেছে, আইন অনুযায়ী মামলা রেকর্ড হওয়ার পরবর্তী সাতদিন অথবা পরবর্তী ১২৫ দিনের মধ্যে পুলিশকে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে হবে। আবার সর্বশেষ আইনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণজনিত মামলায় ডিএনএ রিপোর্ট অবশ্যই দাখিল করতে হবে। এ দুটি আইনের উদ্দেশ্য ছিল, মানুষকে দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার প্রদান করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ সমস্ত মামলার বিভিন্ন রিপোর্ট প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রীতা।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বা ডিএনএ সহ অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রাপ্তির অপেক্ষায় মহানগরীর আটটি থানা এলাকার ৩৮৩টি মামলা মুলতবি রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে ৮০টি, ভিসেরা রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে আটটি, ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার আশায় ১৫২টি, মোবাইল ফরেনসিক প্রতিবেদন না আসায় ঝুলে রয়েছে ১১টি, এমসি‘র জন্য আছে ৩১টি,মাদক সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য ৯৫টি । অন্যান্য কারণে ছয়টি মামলার কার্যক্রম মুলতবি রয়েছে।
এসব মামলার মধ্যে গাজীপুর মহানগরীর সদর থানায় রয়েছে ৭৩টি, বাসন থানায় ৩১টি, কোনাবাড়ী থানায় ৩৯টি, কাশিমপুর থানায় ৩৫টি, গাছা থানায় ৫২টি, পুবাইল থানায় ২১টি, টঙ্গী পূর্ব থানায় ৯৫টি, টঙ্গী পশ্চিম থানায় ৩৭টি মামলা রয়েছে।
মুলতবি থাকা মামলাগুলোর কয়েকটির তদন্ত কর্মকর্তার (আই্ও) সাথে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান,মামলার বাদির উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রকাশ্য ও গোপনীয় ভাবে তাদের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্পন্ন হয়েছে। আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তারা তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে প্রতিবেদন বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপনের জন্য প্রায় প্রস্তত। কিন্তু পূর্বে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ( ডিএনএ, ভিসেরা ইত্যাদি রিপোর্ট) না পাওয়ায় তাঁরা মামলার অভিযোগপত্র অথবা চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে পারছেন না। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে না পারায় তাঁরা মামলার বাদী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিজ্ঞ আদালতের কাছেও অনেক সময় হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। তাঁরা মনে করছেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই কাজ করছেন না অথবা সময়ক্ষেপন করছেন।
জিএমপির একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, আমরা আইনের বাইরে কিছু করতে পারি না। এসব প্রতিবেদন না পাওয়ার কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে কিছুটা বিলম্ব হয়। প্রতিবেদন দ্রুত পাওয়া গেলে আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।
২০২২ সালের শুরুতে মহানগরীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া কয়েকটি মামলার বাদির সাথে কথা হয়। তারা বলেন,পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ বলে প্রতিবেদন আসেনি-তাই আমরা আদালতে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারছি না। আইনজীবীর কাছে গেলে বলে, পুলিশ প্রতিবেদন দেয়নি আমরা কি করতে পারি? ফলে অধিকাংশ মামলার বাদিগণ থানা পুলিশ ও কোর্ট কাছারি এলাকায় ঘুরে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের একাধিক মামলার আসামিপক্ষের একজন আইনজীবী দাবি করেন, ডিএনএসহ মামলা সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন দেরীতে পাওয়ায় আসামিগণ জামিন পাচ্ছে না। ফলে তিনি এবং তার আসামিগণ ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁরা বলেন, সরকারের উচিত ডিএনএর মত স্পর্শকাতর এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন যাতে আরো দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রদান করা যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এ ব্যাপারে গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার দেলোয়ার হোসেন বলেন,সারাদেশের ডিএনএ পরীক্ষা হওয়ায় সিআইডি ল্যাবে অনেক লম্বা সিরিয়াল। তবু আমরা চেষ্টা করছি আইনের ধরাবাধা সময়ের মধ্যেই সঠিক এবং নির্ভুল তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করতে। কোন দোষী ব্যক্তি যেন তদন্ত দুর্বলতার কারণে ছাড় না পায় অথবা কোন নির্দোষ ব্যক্তি যেন অযথা পুলিশি প্রতিবেদনের কারণে হয়রানীর শিকার না হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন সংগ্রহ করার জন্য কর্তৃপক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। এসব প্রতিবেদন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংগ্রহ করে বিজ্ঞ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে পারি।