গণবাণী ডট কম:
মাঠে নামার মুহূর্তে টানেলে সাধারণত খুব বেশি হাসতে দেখা যায় না লিওনেল মেসিকে। কিন্তু গতকালটা ছিল ব্যতিক্রম। ক্লাব সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপ্পের সঙ্গে করমর্দন করলেন। সাবেক সতীর্থ আঁতোয়ান গ্রিজমানকে করলেন আলিঙ্গন। সবার সঙ্গে কথা বললেন হেসে হেসে। ফাইনালের আগে এত উচ্ছল, আর্জেন্টাইন মায়েস্ত্রো কি তবে বুঝতে পেরেছিলেন, অবশেষে সেই মুহূর্তটা আসছে!
বিশ্বকাপের ফাইনাল মেসি আগেও খেলেছেন। ২০১৪ মারাকানার সেই ফাইনালে শিরোপা থেকে ছোঁয়া দূরত্বে ফেরার পর আট বছর পর্যন্ত জীবনের একমাত্র অপ্রাপ্তি হয়ে ছিল সেই ফাইনালটাই। এই আট বছরে বিশ্ব কত পাল্টে গেছে। মেসি নিজে একবার অবসর নিয়ে আবারও ফিরেছেন জাতীয় দলে। তখন কি একবারও ভাবতে পেরেছিলেন, মিটে যাবে তাঁর সব আক্ষেপ! পূরণ হবে তাঁর আজন্ম সাধ। নিশ্চয়ই কোনো দৈববাণী পেয়েছিলেন, নইলে মাঠে নামার আগে কেন মুখে লেগে থাকবে অচেনা হাসি।
সেই হাসিটা আরেকটু হলে মুছেই যেতে বসেছিল মেসির। ফাইনালে তাঁর জোড়া গোলের পরও দলকে প্রায় ডুবতে দেখতে বসেছিল লুসাইলের হাজার হাজার আর্জেন্টাইন সমর্থক। লুসাইল স্টেডিয়ামে ক্ষণে ক্ষণে হৃদ্যন্ত্রের পরীক্ষা নিল আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ফাইনাল। শেষ পর্যন্ত কাঁদলেন মেসি, কাঁদলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। ৩৬ বছরের আক্ষেপ গড়িয়ে পড়ল আনন্দের অশ্রু হয়ে। ৩-৩ গোলের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল গড়াল টাইব্রেকারে। সেখানে দুই শট ঠেকিয়ে মেসি-দি মারিয়ার আলো নিজের দিকে
কাড়লেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে ৩৬ বছর পর বিশ্বসেরা আর্জেন্টিনা। ফুটবলে মেসি পেলেন পূর্ণতা। আর দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করেও আড়ালে চলে গেলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।
লুসাইলে আর্জেন্টিনার নায়ক অবশ্য একাদশের সবাই। টাইব্রেকারে যাঁর শটে আর্জেন্টিনা তাদের আক্ষেপ মিটিয়েছে, সেই গঞ্জালো মন্তিয়েলও নিজেকে দাবি করতে পারেন নায়ক। তাঁর এক হ্যান্ডবলেই ম্যাচকে টাইব্রেকারে নিয়ে গিয়েছিল ফ্রান্স। সেই মন্তিয়েলই শেষ শটে ঘটালেন দায়মুক্তি।
লুসাইলের ফাইনালে খেলতে নেমেই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ২৬ ম্যাচ খেলার কীর্তি গড়েন মেসি। ম্যাচটাকে রঙিন করতে হলে বিশ্বকাপটাও জিততে হতো তাঁকে। এমবাপ্পে প্রায় জিতিয়েই দিয়েছিলেন। সব উত্তেজনা ছাপিয়ে অবশেষে আরাধ্য বিশ্বকাপ জিতলেন মেসি। লুসাইলের ফাইনাল হয়ে থাকল সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাইনাল।
ফ্রান্সের বিপক্ষে ৪-৪-২ ফরমেশনে বলের নিয়ন্ত্রণটা শুরু থেকেই নিজেদের পায়ে রেখে খেলেছে আর্জেন্টিনা। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালেও একই ফরমেশনে খেলেছিলেন মেসিরা। ফরমেশনে পরিবর্তন না এলেও একাদশে এল পরিবর্তন। লিসান্দ্রো মার্তিনেজের পরিবর্তে শুরু থেকেই খেললেন আনহেল দি মারিয়া। খেলেই বদলে দিলেন আর্জেন্টিনার ইতিহাস।
২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার ব্যর্থতার পেছনে বড় কারণ হিসেবে দেখা হয় দি মারিয়ার চোটকে। মারাকানায় তাঁর গোলে ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয় সেটাই প্রমাণ করে। ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিসিমাতেও গোল পেয়েছিলেন দি মারিয়া। কাতারে এসে অধিকাংশ সময়ই চোটের কারণে একাদশের বাইরে থাকলেন। সুস্থ হয়ে নেদারল্যান্ডস ম্যাচে অল্প কিছুক্ষণ খেলার সুযোগ পেলেন। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সুযোগই পেলেন না। লিওনেল স্কালোনি চমকটা দেখালেন দি মারিয়াকে ফাইনালে একাদশে খেলার সুযোগ করে দিয়ে।
নেমেই ফ্রান্সের রক্ষণটাকে আলগা করে দিলেন দি মারিয়া। মেসি-হুলিয়ান আলভারেজকে মার্কিং করতে গিয়ে বাঁ প্রান্তে দি মারিয়াকে বারবার অরক্ষিত থাকার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন ফরাসি ডিফেন্ডাররা। ২১ মিনিটে এ রকম অরক্ষিত অবস্থায় বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন জুভেন্টাস ফরোয়ার্ড। তাঁকে ঠেকাতে গিয়ে পায়ে পা গলিয়ে ফেলে দিলেন উসমানে দেম্বেলে। ফাউলের বাঁশি বাজালেন পোলিশ রেফারি সিমন মার্চিনিয়াক। ২৩ মিনিটে শট নিতে এলেন মেসি। স্নায়ুচাপে খানিকটা ভুগলেও ঠান্ডা মাথায় শট নিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। হার মানলেন ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিস।
ফাইনালের পার্শ্বনায়ক থেকে দি মারিয়ার নায়ক হওয়ার মুহূর্তটা চলে এল ১৩ মিনিট পর। আর্জেন্টিনা পেল অসাধারণ ছয় টাচের ফসল। ৩৬ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে মেসির পাস থেকে বল টেনে একাই বক্স পর্যন্ত নিয়ে যান আলেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার। চাইলে শটটা নিতে পারতেন নিজেই। বাঁ প্রান্তে দি মারিয়াকে অরক্ষিত অবস্থায় দেখে তাঁর দিকেই বল বাড়ান ম্যাক অ্যালিস্টার। এক টাচেই দারুণ ফিনিশিংয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোলের বৃত্ত পূরণ করেন দি মারিয়া। গোল পেয়ে চোখ ভরে এল অশ্রু। মিটে গেল আট বছর আগে ফাইনালে খেলতে না পারার আক্ষেপ।
দ্বিতীয়ার্ধে গোল করতে না পারায় অলিভিয়ের জিরু থেকে শুরু করে আঁতোয়ান গ্রিজমানকেও পর্যন্ত পাল্টে ফেলেন ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম। এই পরিবর্তিত একাদশ নিয়েই ৯০ সেকেন্ডের ব্যবধানে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন সারা ম্যাচে ঘুমিয়ে থাকা দৈত্য কিলিয়ান এমবাপ্পে। অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে ম্যাচে ফিরল ফ্রান্স।
পুরো আসরেই গোল করে এগিয়ে থাকার পর শেষ ২০ মিনিটে বারবার খেই হারিয়েছে আর্জেন্টিনার রক্ষণ। ফ্রান্সের বিপক্ষেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ৭৯ মিনিটে বদলি ফরোয়ার্ড রান্দাল কোলো মুয়ানিকে বক্সে ফেলে দিয়ে ফ্রান্সকে পেনাল্টি উপহার দেন নিকোলাস ওতামেন্দি। পরের মিনিটে এমবাপ্পের শট ঝাঁপিয়েও ঠেকাতে পারেননি আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ।
সেই গোলেই জেগে উঠল ফ্রান্স। জেগে উঠলেন এমবাপ্পে। ৮১ মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে কিংসলে কোমানের বাড়িয়ে দেওয়া বল বক্সের বাইরে থেকে এমবাপ্পেকে বাড়ান। ফাঁকায় ছিলেন এমবাপ্পে। তাঁর জোরের সঙ্গে নেওয়া শট এবারও ঠেকাতে পারেননি মার্তিনেজ। মেসির ৬ গোল টপকে গোল্ডেন বুটের একক ভাগীদার হলেন এমবাপ্পে।
২-২ সমতায় খেলা অতিরিক্ত সময় গড়ানোর মুহূর্তে শেষ চেষ্টা করেছিলেন মেসি। বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া তাঁর দুর্দান্ত শট ফিরিয়ে হুগো লরিস বাঁচিয়ে রাখেন ফ্রান্সের সম্ভাবনা। ১০৫ মিনিটে বক্সের মুখে লাওতারো মার্তিনেজের শট ঠেকান দায়োত উপামেকানো।
দুশ্চিন্তা-চাপের মুহূর্তে যখন খেলা গড়াচ্ছে টাইব্রেকের দিকে, তখনই মেসি দেখালেন জাদু। বক্সের ভেতর থেকে লাওতারো মার্তিনেজের শট হুগো লরিস ফিরিয়ে দিলেও ফিরতি বলে শট নেন মেসি। উপামেকানো সেই শট ঠেকিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পোস্টের ভেতর থেকে। গোললাইন প্রযুক্তিতে আবারও আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন মেসি।
এগিয়ে গিয়েও স্বস্তি ফিরল না আর্জেন্টিনার। ১১৬ মিনিটে বক্সের ভেতর হ্যান্ডবল করে বসলেন গঞ্জালো মন্তিয়েল। আবারও পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। ১১৮ মিনিটে গোল করে ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে ফাইনালে হ্যাটট্রিক তুলে নেন এমবাপ্পে।
শেষ সময়ে ফ্রান্সকে প্রায় জিতিয়েই দিয়েছিলেন কোলো মুয়ানি। শেষ মিনিটে তাঁর নেওয়া শট দারুণ এক সেভে আর্জেন্টিনাকে টাইব্রেকে নিয়ে যান এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। টাইব্রেকে তিনিই হলেন নায়ক। ফেরালেন কিংসলে কোমান ও অরলিয়েঁ চুয়ামেনির শট।
এই একটা শিরোপার জন্য তিন যুগের দীর্ঘ অপেক্ষা। যে বিশ্বকাপই দিতে পারত মেসির সোনায় মোড়ানো ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা। লুসাইল স্টেডিয়ামে সব আক্ষেপ মুছে গেল। সব হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বসেরা মেসির আর্জেন্টিনা।