গণবাণী ডট কম:
কবি হেলাল হাফিজ ফেরীঅলা কবিতায় বলেছিলেন, কষ্ট নেবে কষ্ট হরেক রকম কষ্ট আছে কষ্ট নেবে কষ্ট! তিনি কষ্টের ফেরি করতে চেয়েছিলেন। মুলত এটি এক বেকারেরই কষ্ট ছিল। কিন্তু বেকারদের বেকারত্ব দুর করতে এবার চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান নিজেরাই ফেরীঅলা হয়ে চাকরী নিয়ে হাজির হয়েছেন চাকরি মেলায়। হরেক রকম চাকরি। ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা বেতনের চাকরি।
এমনি ব্যতিক্রমি চাকরী মেলার আয়োজন করেছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। শনিবার সকালে এ মেলার উদ্বোধন করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি।
চাকরীদাতা ও চাকরী প্রার্থীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ী মাঠে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী চাকরি মেলা। শুধু চমৎকার ও আকর্ষণীয় একটি সিভি নিয়ে হাজির হলেই যোগ্যপ্রার্থীদের মধ্যে থেকে ১২শ বেকার চাকরি পাবেন বলে আশা করছেন আয়োজকরা।
দুপুরে মেলায় গিয়ে দেখা গেল, সকাল থেকেই হাজারো চাকরী প্রার্থীর পদচারণায় মেলা প্রাঙ্গণ মুখড় হয়ে ওঠে। চাকরী প্রার্থী বিভিন্ন বয়সী ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টলে গিয়ে চাকরী দাতা কর্মকর্তাদের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারছে। নতুন চাকরির আশায় জীবন বৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন তারা। জেলার বেকার যুবক যবতীদের পাশে দাঁড়াতে মেলায় অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
চাকরি লাভের আশায় পিতার সাথে এসেছে তনয় কিশোর দেব। তার সাথে আছে ছোট বোন তনয়া রানী দেবী। একজন এমবিএ ও অন্যজন বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তারা জানান, এখানে একসাথে এতগুলো বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখে আমরা অভিভূত। আমরা তাদের সাথে সরাসরি কথা বলেছি, তারা কি ধরণের লোক চায় সেসব বিষয়ে ধারণা পেয়েছি। আমাদের অবিজ্ঞতা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। আশা করছি মেলা থেকেই আমরা চাকরি পাব।
চাকরি মেলায় চাকরি লাভের আশায় এসেছেন সানজিদা ইসলাম। তিনি বলেন, আমার কাছে এ ধরণের মেলা এটাই প্রথম। কোন রকম তদবির বা ঘুরাঘুরি-হয়রানি ছাড়াই এখানে সরাসরি চাকরি দাতা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা যাচ্ছে। তাদের চাহিদা জানা যাচ্ছে, সত্যিই অসাধারণ বিষয়। এখানে এসে অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি।
মেলায় আলোচক হিসাবে অংশ নেন বিডিজব লি: এর এজিএম (প্রোগ্রাম) মোহাম্মদ আলী ফিরোজ। তিনি বলেন, মেলায় চাকরী প্রার্থীদের বিরাট উপস্থিতি লক্ষণীয়। তিনি বলেন, অনেক সময় চাকরি প্রার্থী মনোনয়ন বোর্ডের সামনে গিয়ে মাথার চুল আচঁরায়, শার্টের কলার বা কাপড় ঠিক করে। অনেকে বুঝাতে চায় চাকরিটা তার কতবেশী প্রয়োজন। আমরা তাদের বুঝাতে চেয়েছি, আপনার সমস্যার কথা শুনে কেউ আপনাতে চাকরি দিবে না। এজন্য আপনার নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে।
বেক্সিমকো গ্রুপের স্টলে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিষ্ঠানটি ৫টি ক্যাটাগড়িতে চাকরি দেওয়ার জন্য মেলায় এসেছে। এসব পদের জন্য তারা দুটি বাক্সে আবেদন গ্রহণ করছেন। সিনিয়র ব্যবস্থাপক (এইচআর) সৈয়দ শাকিল আহাদ জানান,মেলা থেকে বেক্সিমকো আশা করছে কমপক্ষে ২৫০-৩০০ জন যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, আমাদেরে এখানে আমরা ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা বেতনের চাকরি জন্য যোগ্যপ্রার্থীর অপেক্ষায় আছি। ভবিষ্যতে আমাদের নতুন প্রকল্পে আরো কয়েক হাজার লোক লাগবে। আমাদের কাছে জমা দেওয়া সিভি থেকে আমরা তাদেরও বাছাই করার চেষ্টা করবো।
মেলার উদ্বোধন করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, আমাদের দেশকে স্বাবলম্বী করতে হবে, এজন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন। আমাদের দেশে যে সমস্ত কলকারখানা রয়েছে সে সকল কারখানায় লোকজনকে চাকরি দেয়ার পর দেখতে হবে কি ধরনের যোগ্যতা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরো বলেন, বিসিএস সহ চাকরি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার কোঠা আরো বাড়ানোর জন্য কাজ করছে সরকার। চাকরি প্রার্থীদের জানতে হবে নিয়োগকারীরা কি ধরণের স্কিলড লোক চায়। সেভাবেই নিজেদের তৈরী করতে হবে। এ সময় তিনি চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ারও আহ্বান জানান।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বেকার সৃষ্টির কারখানা না হয় সেদিকটায় নজর দিতে হবে। এমনটা হলে সেটা শুধু রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হবে। শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী যোগ্যতম নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে হবে। এ জন্য সরকার ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের উপর জোর দিয়েছে। এতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে উঠতে সহায়ক হবে।
বক্তব্যকালে মন্ত্রী একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধরুন জেলা প্রশাসক যদি পিয়নের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। সেখানে কমপক্ষে দুই হাজার আবেদন জমা পড়বে। আবেদনকারীদের মধ্যে দেখা যাবে মধ্যে প্রায় এক হাজার এম এ পাস করেছ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়ে পিয়ন হতে যাচ্ছে। এতো কষ্ট করে পড়াশোনা করলেও বাস্তবে এটি কোনো কাজে লাগলো না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলি থেকে প্রতিবছর উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে বের হচ্ছে। রাস্ট্রের সম্পদ ও মেধার অপচয় হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বেকার তৈরির কারখানা হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে আমাদের পাঠ্যসূচি পরিবর্তন হচ্ছে, যুগোপযোগী করা হচ্ছে। যেন বেকার সৃষ্টি না হয়।
মন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ড. কুদরাত-এ-খুদা জাতীয় শিক্ষা কমিশন যেটা তিনি গঠন করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেননি। যেখানে বলা হয়েছিল সাধারণ শিক্ষার দরকার নেই। মুষ্টিমেয় লোক উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করবে। অন্যেরা টেকনিক্যাল শিক্ষা নিবে, ভোকেশনাল শিক্ষা নিবে অর্থাৎ যে শিক্ষা তাদের কাজে লাগবে মানে ব্যবহারিক শিক্ষা। যেটা তাদে জীবনে কাজে লাগাতে পারবে।
মেলার আয়োজক গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, আমাদের গাজীপুরে প্রচুর প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানে চাকরি পাওয়া সম্ভব। চাকরী প্রার্থী ও চাকরিদাতার মধ্যে যাতে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা যায়, সেজন্য আমরা এ মেলার আয়োজন করেছি। এখান থেকে আমাদের শিক্ষিত প্রজন্ম প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে এসে নিজেদের ঘাটতি গুলো বুঝতে পারবে, কোন মাধ্যম বা তদবির ছাড়াই কম সময়ে চাকরি লাভের সুযোগ পাবে। এতে করে প্রতিষ্ঠান গুলোও লাভবান হবে। তিনি আরো জানান, মেলায় বেক্সিমকো, স্কয়ার, নেসলে, ওয়ালটন, প্রাণ আরএফএল , বাটাসহ দেশসেরা ৪০টি মতো প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। আশা করছি রবিবার মেলার শেষে এখান থেকে অন্তত ১২শ লোকের চাকরির সু সংবাদ দিতে পারবো।
তিনি আরো জানান, মেলায় বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ তাদের কাজ করার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হচ্ছে। ক্যারিয়ার বাছাই, জীবন বৃত্তান্ত প্রস্তুতকরণ ও দক্ষতা কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয় নিয়ে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। চাকরি ও ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রযুক্তি ও ভাষাগত দক্ষতা কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় ও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আলোচনা করা হচ্ছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম, কুমিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: গিয়াসউদ্দিন মিয়া, বিজিএমইএ-র সভাপতি ফারুক হাসান, গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন) মোঃ ওয়াহিদ হোসেন, ভাষা শহিদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক প্রমুখ।