গণবাণী ডট কম:
মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত তাবলীগ জামায়াতের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা রাজধানীর উত্তরে তুরাগ নদের তীরে গাজীপুরের টঙ্গীতে আগামী ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে। তাবলীগের মুসুল্লীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ইজতেমায় আগত মুসুল্লীদের জন্য ১৬০ একর আয়তনের বিশালাকার ইজতেমা ময়দানের সামিয়ানা টানানো প্রায় শেষ। এছাড়া ভূমি উন্নয়ন, বিদ্যুৎ এবং মাইকের সংযোগ স্থাপনসহ অন্যান্য কাজের পাশাপাশি সার্বক্ষনিক পানি সরবরাহ ও পয়:নিস্কাশন, গ্যাস সরবরাহ প্রভৃতি কাজে জেলা প্রশাসন ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন সহায়তা দিচ্ছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শেষ করেছেন। সব মিলিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির কাজ শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে জেলাভিত্তিক খিত্তার তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ, র্যা ব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা অংশ নিচ্ছেন।
সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়,শৈত্য প্রবাহের কারণে কনকনে শীত উপেক্ষা করে তাবলীগ জামাতের সদস্যসহ স্বেচ্ছাসেবী মুসল্লিরা স্বেচ্চাশ্রমের ভিত্তিতে শুধমাত্র সওয়াব লাভের আশায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সাথে মুসুল্লিদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ সরকরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নিরলসভাবে কাজ করছে। ইজতেমা মাঠের ১৬০ একর জায়গায় বিশাল সামিয়ানা টানানোর কাজ প্রায় শেষ। বিশাল ময়দানে খিত্তাভিত্তিক মাইক বাঁধা এবং বৈদ্যুতিক লাইট সংযোগের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদের পূর্বপাড়ে নামাজের মিম্বর ও বয়ান মঞ্চ এবং তুরাগ নদ ঘেষে ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোনায় বিদেশি মেহমানদের জন্য নির্ধারিত কামরা, তাশকিল কামরা, জুড়নেওয়ালি জামাতের কামরা, শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের বয়ান শোনার জন্য পৃথক কামরা তৈরি করা হয়েছে। ইজতেমার নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি স্থাপন, ওয়াচ টাউয়ার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। মুসুল্লিদের তুরাগ নদ পারাপারের জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা এবার ৫টি পল্টুন সেতু নির্মাণ করেছেন। এছাড়া ইজতেমার মাঠে চলাচলের জন্য নতুন রাস্তা নির্মাণ ও পুরাতন রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ব ইজতেমায় দুটি গ্রুপ রয়েছে। একটি মাওলানা জুবায়ের গ্রুপ ও আরেকটি মাওলানা সাদ গ্রুপ। এবার বিশ্ব ইজতেমায় প্রথম পর্বে মাওলানা জুবায়ের অনুসারী গ্রুপ ও দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সাদ কান্ধালভীর অনুসারীরা অংশ নেবেন। প্রথম পর্ব ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। ১৬ জানুয়ারি সকাল ১১টার মধ্যে ইজতেমার মাঠ প্রশাসনের নিকট বুঝিয়ে দিবে। এরপর ৪দিন বিরতী দিয়ে ২০ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। একইভাবে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ২২ জানুয়ারি শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা। করোনার কারণে ২০১৯ সালের পর ইজতেমা আয়োজন সম্ভব হয়নি। একারণে এবারের ইজতেমায় মুসুল্লী সমাগম বেশী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রথম পর্বের ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের জন্য জেলা ভিত্তিক খিত্তায় অবস্থান হলো, গাজীপুর (খিত্তা-১), টঙ্গী (খিত্তা-২, ৩ ও ৪), ঢাকা (খিত্তা-৫ থেকে ১৮ ও ২১, ২২, ২৫, ২৭, ২৮, ৩০), রাজশাহী (খিত্তা-১৯), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (খিত্তা-২০), নাটোর (খিত্তা-২৩), নওগাঁ (খিত্তা-২৪), নড়াইল (খিত্তা-২৬), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-২৯), টাঙ্গাইল (খিত্তা-৩১), রংপুর (খিত্তা-৩২), গাইবান্ধা (খিত্তা-৩৩), লালমনিরহাট (খিত্তা-৩৪), মুন্সীগঞ্জ (খিত্তা-৩৫), যশোর (খিত্তা-৩৬), নীলফামারী (খিত্তা-৩৭), বগুড়া (খিত্তা-৩৮), জয়পুরহাট (খিত্তা-৩৯), নারায়ণগঞ্জ (খিত্তা-৪০), ফরিদপুর (খিত্তা-৪১), ভোলা (খিত্তা-৪২), নরসিংদী (খিত্তা-৪৩), সাতক্ষীরা (খিত্তা-৪৪), বাগেরহাট (খিত্তা-৪৫), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৪৬), মেহেরপুর (খিত্তা-৪৭), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৪৮), ময়মনসিংহ (খিত্তা-৪৯, ৫১), শেরপুর (খিত্তা-৫০), জামালপুর (খিত্তা-৫২), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৫৩), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-৫৪), নেত্রকোনা (খিত্তা-৫৫), ঝালকাঠি (খিত্তা-৫৬), বান্দরবান (খিত্তা-৫৭), বরিশাল (খিত্তা-৫৮), পিরোজপুর (খিত্তা-৫৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৬০), কক্সবাজার (খিত্তা-৬১), সিলেট (খিত্তা-৬২), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৬৩), ফেনী (খিত্তা-৬৪), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৫), লক্ষ্মীপুর (খিত্তা-৬৬), চাঁদপুর (খিত্তা-৬৭), ব্রাহ্মণবাড়িয়া (খিত্তা-৬৮), খুলনা (খিত্তা-৬৯), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭০), বরগুনা (খিত্তা-৭১), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৭৪), কুমিল্লা (খিত্তা-৭৫), তুরাগ নদের পশ্চিমপাড় কাঁচাবাজারে মৌলভীবাজার (খিত্তা-৭৬), রাজবাড়ী (খিত্তা-৭৭), মাদারীপুর (খিত্তা-৭৮), শরীয়তপুর (খিত্তা-৭৯), মানিকগঞ্জ (খিত্তা-৮০, সাফা টাওয়ার), রাঙ্গামাটি (খিত্তা-৮১), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৮২), দিনাজপুর (খিত্তা-৮৩), পাবনা (খিত্তা-৮৪), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৮৫), ঝিনাইদহ (খিত্তা-৮৭, যমুনা প্লট), মাগুরা (খিত্তা-৮৮, যমুনা প্লট), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৮৯, কামারপাড়া বেড়িবাঁধ বঙ্গবন্ধু মাঠ), পঞ্চগড়ের (খিত্তা-৯০) কামারপাড়া হাইস্কুল মাঠ-বধির স্কুল ভবন) জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। এছাড়াও ময়দানের চারপাশে ১১ ও ১২নং খিত্তার কিয়দংশ, ৩২ ও ৩৭নং খিত্তার মাঝামাঝি ১২নং, ৭২, ৭৩, ৮৬ ও ৯১নং খিত্তাগুলো সংরক্ষিত হিসেবে রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটি।
ইজতেমার প্রথম পর্বের তথ্য সমন্বয়ক জহির ইবনে মুসলিম জানান, ইজতেমা মাঠের শামিয়ানা টানানো, বিদ্যুৎ ও মাইক সংযোগের কাজ প্রায় শেষ। মুসুল্লিদের সুবিধার জন্য প্রয়োজন সব কিছুই করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, প্রথম পর্বে অংশ গ্রহণে ইচ্ছুক দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি আগামী ১২ জানুয়ারির মধ্যেই ইজতেমা মাঠে তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নেবেন।
বিশ্ব ইজতেমা নিরাপত্তার বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা নিরাপত্তা চাদরে মোড়ানো থাকবে। পুলিশ, র্যা বসহ ১০ হাজারের অধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবেন। সিসি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার ও রুফটপ থেকে পুরো ইজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এছাড়া স্পেশালাইজড টিমসহ প্রতিটি ‘খিত্তা’য় সাদা পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন এবং তুরাগে নদীতে থাকবে নৌ টহল। অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রতি খিত্তায় এবার দুটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা হবে। স্পেশাল ফোর্স হিসেবে থাকবে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং আকাশে থাকবে হেলিকপ্টার টহল।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ বলেন, ইজতেমায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে দুটি উপকেন্দ্র থেকে লাইন সংযোগ দেয়া হয়েছে। মুসুল্লিদের পানির জন্য প্রয়োজনীয় নলকুপ ও পয়নিষ্কাশন ও বর্জ্য অপসারণের সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মশার ঔষধ ছিটানো হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা ক্যাম্প ও এ্যাম্বুলেন্স থাকবে। মহাসড়কে ও বিভিন্ন সড়কে লাইট স্থাপন করা হয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, ইজতেমা মাঠের সকল প্রস্তুতি প্রায় শেষ। মুসুল্লিদিরে সব রকম সুযোগ ও সেবা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করছে। মুসুল্লীগণ যাতে নিরাপদে আসতে ও যেতে পারেন সে জন্য ট্রেন ও বাসের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইজতেমায় আসার পর তাদের জন্য চলাচলের পথ, থাকার জন্য প্যান্ডেল নির্মান, পয়নিস্কাশনের ব্যবস্থাসহ সকল কাজ প্রায় শেষ। বিশ্ব ইজতেমার নিরাপত্তার জন্য ওয়াচ টাওয়ার, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এবার ইজতেমা ময়দান এলাকায় নিরাপত্তা কর্মী আরো বৃদ্ধি করে গড়ে তোলা হবে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। শান্তিপুর্নভাবে বিশ্ব উজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ৬ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত ফলোআপ সভায় সাংবাদিকদের জানান, করোনার পরে তারা দুটি গ্রুপ ইজতেমা করেছেন। তখন কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। আমার মনে হয় তাদের মধ্যে নতুন করে ভুল বোঝাবুঝি হবে না। তারা সুন্দরভাবে ইজতেমা শেষ করবেন।