গণবাণী ডট কম:
করোনার কারণে দুই বছর বিরতীর পর দেশ বিদেশের লাখো মুসুল্লী মহান আল্লাহর সন্তোষ্টি লাভ ও দ্বীনের দাওয়াত পৌছে দেয়ার আশায় গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে এসে পৌছেছেন। তাঁরা ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে কনকনে শীত উপেক্ষা করে সকল বাঁধা ও শংকাকে পেছনে ফেলে বাস, ট্রাক, কার, পিকআপ ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে দলে দলে কাঁধে-পিঠে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে ইজতেমা ময়দানে এসে নিজ জেলার খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে ইজতেমা ময়দান। মুসুল্লীদের পদচারণায় ইজতেমা ময়দান ও তার আশপাশ এখন মুখরিত। ময়দানের ভিতরে চলছে বয়ান জিকির তালিম আর মাশোআরা।
তবে, এবারেও ইজতেমায় বিশ্ব তাবলীগের আমীর মাওলানা সাদকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দুই গ্রুপ পর্যায়ক্রমে দুই পর্বে ইজতেমার ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। ১৩ জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি মাওলানা যোবায়ের পন্থি গ্রুপ এবং ২০ জানুয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি মাওলানা সাদপন্থি গ্রুপ ইজতেমা আয়োজন করবেন।
বিশ্ব ইজতেমার মুসুল্লীদের সেবার জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে তাবলিগের মুরুব্বীগণ, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীর সাড়ে ৭ হাজারের অধিক সদস্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা বলয়।
শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) বাদ ফজর মাওলানা জিয়াউল হকের আনুষ্ঠানিক আম বয়ানের মধ্য দিয়ে আলমি শুরার তত্ত্বাবধানে (জুবায়েরপন্থী)এবারের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার কথা। বুধবার রাত থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিগণ দলে দলে জামাত বন্দি হয়ে আসতে শুরু করেন। ইতিমধ্যেই পুরো ইজতেমা ময়দান পুরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবারও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে দল বেধে মুসল্লিরা আসছেন ইজতেমা ময়দানে। ময়দানে মুসুল্লির উপস্থিতি বেশী হওয়ায় বৃহস্পতিবার বাদ জোহর মাওলানা রবিউল হক ও বাদ আসর মাওলানা মো. ফারুক হেদায়েতি বয়ান করেছেন। বাদ মাগরিব মাওলানা ইব্রাহিম ও কারি জুবায়ের মুসল্লিদের মাঝে বয়ান করবেন। ।
বৃহস্পতিবার ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ব ইজতেমার ১৬০ একর আয়তনের সুবিশাল প্যান্ডেলের কোথাও ঠাঁই নেই। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে ইজতেমা ময়দান। মুসুল্লীদের পদচারণায় ইজতেমা ময়দান ও তার আশপাশ এখন মুখুরিত। ময়দানের ভিতরে চলছে বয়ান, জিকির, তালিম আর মাশোআরা। ময়দানের ভিতরে জেলা ভিত্তিক খিত্তা অনুযায়ী ইজতেমা ময়দানে সমবেত মুসুল্লিগণ কেউ নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ সারছেন। অনেকে নিজ নিজ দলের আমীরের দেওয়া দীনের বয়ান শুনছেন। নিজ দলের আমীরের মাধ্যমে ইজতেমার যাবতীয় ইমান, আদব, আখলাক ও শৃংখলা নিয়ে কথা বলছেন। ইজতেমায় তাদের দলের সদস্যদের কার কী কাজ, কে কী দায়িত্ব পালন করবে তা ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে।
শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে দেশের সর্ববৃহৎ জুম্মার নামাজ। এতে প্রায় ১০ লাখ মুসল্লি এক জামাতে শরিক হয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজধানী ও গাজীপুরের বিভিন্ন উপজেলা এবং আশপাশের জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এ বৃহৎ জুম্মার নামাজে শরিক হবেন।
ইজতেমা মাঠের মুরুব্বিরা জানান, তাবলীগ জামাতের উদ্যোগে প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। মাঠের সব কাজ করা হচ্ছে পরামর্শের মাধ্যমে। এখানে বিদ্যুৎ, পানি, প্যান্ডেল তৈরি, গ্যাস সরবরাহ প্রতিটি কাজই আলাদা আলাদা গ্রুপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশ থেকেই তাবলীগ জামাতের অনুসারী মুসলমানরা অংশ নেন। তারা এখানে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ আলেমদের বয়ান শোনেন এবং ইসলামের দাওয়াতী কাজ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেওয়ার জন্য জামাতবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যান।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী মুফতি জহির ইবনে মুসলিম বলেন, বুধবার থেকে দেশি-বিদেশি মুসল্লিরা ময়দানে এসে ইজতেমায় যোগ দেওয়া শুরু করেছেন। বিদেশিরা ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে তাদের জন্য উন্নত তাবুতে এসে অবস্থান নিচ্ছেন। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৬টি দেশের প্রায় দেড় হাজার বিদেশি মেহমান এসে ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের পাশাপাশি একই সময়ে দেশের প্রায় সব জেলা থেকে লাখো মুসল্লি এসে ময়দানে নির্ধারিত খিত্তায় হাজির হয়েছেন।
তিনি আরো জানান, আল্লাহর অশেষ রহমতে সভাপতিহীন বিশ্ব ইজতেমার এতো বড় আয়োজন প্রতিবছরই অত্যন্ত সু-শৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা হয়। এজন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পুরো ইজতেমা ময়দানকে মুরুব্বীদের পরামর্শে সাজানো হয়। ময়দানে জেলাওয়ারি মুসল্লিদের অবস্থান, রান্না-বান্না করার স্থান, টয়লেট, অজুখানা, গোসলখানা সবই সুর্নিদিষ্ট করা থাকে।
এদিকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, ইজতেমা ময়দানকে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায় রাখতে সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ। ইজতেমার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার পুলিশ ও র্যারবসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। কয়েকটি স্তরের এ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ইজতেমা ঢেকে রাখা হবে। নিরাপত্তার জন্য সাদা পোশাকে নজরদারী ও প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারীর উপর জোর দেয়া হয়েছে। ডিএমপির বোম্ব পিসপোজেল টিম, সোয়াট টিম, বিজিবি, পুলিশ, র্যা ব, আনসার সদস্য, সিসি টিভি, ওয়াচ টাওয়ার, রুফটপ থেকে মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ, আগত মুসুল্লীদের লাগেজ ও দেহ বোতল্লাশী, সাদা পোশাকে নিরাপত্তার বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারী অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম।
পুলিশ ও র্যা বের কন্ট্রোল রুম থেকে নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাও ব্যবহার করা হচ্ছে। নিরাপদ যাতায়াত ও সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে প্রতিদিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে নির্মিত বিদেশি নিবাসে বিদেশি মুসল্লিরা থাকবেন। ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশে মুসল্লিদের পারাপারের জন্য তুরাগ নদীর উপর ৫টি স্থানে ৫টি ভাসমান সেতু স্থাপন করেছে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড। বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়ত এবং সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে পুলিশ বিভাগ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
র্যাবের কার্যক্রম:
বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারির সুবিধার্থে সমগ্র ইজতেমা ময়দারকে ঘিরে থাকছে র্যা বের অবজারভেশন পোস্ট। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র করার লক্ষ্যে র্যা বের গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে র্যা বের পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য ২৪ ঘণ্টা বিশ্ব ইজতেমা মাঠে পর্যায়ক্রমে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া একটি প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পর্যাপ্ত সিসিটিভির মাধ্যমে সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করা হবে। ইজতেমার অভ্যন্তরে ছদ্মবেশে ও বিশেষ পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি ও আভ্যন্তরীণ টহলের মাধ্যমে স্থল ফোর্স, নৌ টহলের পাশাপাশি হেলিকপ্টার যোগে পর্যায়ক্রমে টহল প্রদানের মাধ্যমে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ ও যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনারোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। র্যা বের বোম্ব স্কোয়াড এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হবে। মুসল্লিদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে র্যা বের মেডিকেল টিম দায়িত্ব পালন করবে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসন বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কর্মকাণ্ড সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগের কাজের সমন্বয় করে থাকে। বিদেশি মেহমানদের আবাসস্থল নির্মাণের নিমিত্তে টিন সরবরাহ, বিভিন্ন দফতরের কন্ট্রোল রুমের স্থান নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা বিভাগীয় প্রশাসনের দিক নির্দেশনায় বিভিন্ন কার্যাদি তদারকি করা হচ্ছে। সরোপরি বিশ্ব ইজতেমার সকল দিক জেলা প্রশাসন পর্যবেক্ষণ করছে, যখন যেখানে যা প্রয়োজন সেগুলোর ব্যবস্থা করছে।