গণবাণী ডট কম:
মহান আল্লাহর দরবারে গুনাহ থেকে মুক্তি, আখেরাতের নাজাত, মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ কামনায় গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হলো এবারের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। মোনাজাত শেষে মুসুল্লিরা জামাতবদ্ধ হয়ে ইসলামী দাওয়াতি কাজে বিভিন্ন এলাকার উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়বেন।
রেববার সকাল ৯টা ৫৭ মিনিট থেকে ১০টা ২০মিনিট পর্যন্ত প্রায় ২৩ মিনিট স্থায়ী মোনাজাত চলাকালে ইজতেমার মূল ময়দান ও আশপাশের এলাকায় পিন পতন নীরবতা নেমে আসে। অশ্রুসিক্ত নয়নে দুই হাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে একসাথে প্রার্থনায় অংশ নেন লাখ লাখ মুসুল্লি। এসময় থেমে থেমে এই নীরবতা ভেঙ্গে পুরো এলাকা আমিন, ছুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত প্রকম্পিত হয়ে উঠে।
পবিত্র কুরআনের প্রার্থনামূলক বিভিন্ন আয়াত উচ্চারণের মাধ্যমে ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শুরু করেন তাবলীগ জামাতের কাকরাইল মারকাজ (কেন্দ্রীয়) মসজিদের খতিব শীর্ষ মুরব্বী মাওলানা ক্বারী জোবায়ের। মোনাজাতে প্রথমে আরবী, পরে বাংলা ও শেষে উর্দুতে ইজতেমার কামিয়াবি, অংশগ্রহণকারীসহ সব মুসলমানের গুনাহ মাফ, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন মাওলানা জোবায়ের। এসময় থেমে থেমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ কান্নাকাটি, রোনাজারি ও আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখর করে তুলেন ইজতেমা ময়দান এলাকা। লাখ লাখ মানুষের কান্নার আওয়াজে ইজতেমার ময়দানে এক অভূতপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
রোববার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়,ইজতেমা ময়দান মানুষে পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মুসুল্লি রাতে ময়দানে জায়গা না পেয়ে কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে রেল স্টেশন, হাসপাতাল ও বিভিন্ন বিপনী বিতানের বারান্দায়, নির্মাণাধীন ও পরিত্যক্ত বিভিন্ন ভবনে ও চারপাশের সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নেন। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার রাত থেকেই আশপাশের জেলা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা বাস, ট্রেন, ট্রাক ও ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে ইজতেমাস্থলে আসতে থাকেন। শনিবার মধ্যরাত থেকে ইজতেমা এলাকায় সব ধরণের যানবাহন বন্ধ থাকায় লাখ লাখ মুসুল্লি রিকশা, ভ্যান, অটোরিক্সা ও পায়ে হেটে ইজতেমা ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ভোর থেকেই লাখো মুসুল্লি মহাসড়কে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে করে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে এসে সমবেত হন। বিপুল সংখ্যক নারী মুসুল্লীরাও মোনাজাতে অংশ নিতে ইজতেমার আশেপাশের সড়কে সকাল থেকেই অবস্থান নেন। মোনাজাত শেষ না হওয়া পযন্ত ইজতেমামুখী জনস্রোত আসা অব্যাহত থাকে। এবার অন্যান্য বারের চেয়ে প্রায় আধা ঘন্টা আগে আখেরী মোনাজাত শুরু হওয়ায় অনেকে সড়কে দাড়িয়ে ও হাটতে হাটতে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন। অনেকে আশপাশের কল কারখানা, মসজিদ, মাদ্রাসা, বাসার ছাদে অবস্থান নিয়ে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
আয়োজকদের ধারণা, ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে প্রায় ২০ লাখ মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। এছাড়াও প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী,যুব ও ক্রিড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল,সংসদ সদস্য(ঢাকা-১৮) হাবিব হাসান ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ। মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমা ময়দান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত মাইকের ব্যবস্থা করা হয়।
আখেরি মোনাজাত শেষে ফিরতি পথে ভোগান্তি:
আখেরি মোনাজাত শেষে ইজতেমা মাঠ ও এর আশপাশের এলাকা থেকে নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হতে শুরু করেন মুসুল্লিরা। ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে যোগ দিতে আসার পথে যতটা ভোগান্তি ছিল, ফিরতি পথে মানুষের ভোগান্তি ছিল অনেক বেশী।
বিশ্ব ইজতেমা মাঠ থেকে উত্তরে গাজীপুর শহর কিংবা দক্ষিণে রাজধানীতে সরাসরি ফেরার কোনো গণপরিবহন ছিল না। আখেরি মোনাজাত শেষে যারা ওই পথে প্রবেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তাদের সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। অধিকাংশ মানুষকে হেঁটে হেঁটে রওনা দিতে হয়েছে। যারা প্রাইভেটকার, সিএনজি, ভ্যান, মোটরসাইকেল, পিকাপ ভ্যান ও অটোরিকশা করে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাদের গুনতে হয়েছে ৩/৪ গুন বেশী ভাড়া। মোনাজাত শেষ হওয়ার পর রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে ও গাজীপুরের চৌরাস্তা বিভিন্ন সড়ক এলাকায় এ চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীগামী মানুষের ঢল নাম থাকে বিমানবন্দর সড়কে। বিশেষ করে যারা টঙ্গী ইজতেমা মাঠে না যেতে পেরে যারা স্টেশন রোড, হোসেন মার্কেট উত্তরা কিংবা বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়া মুসুল্লিদের ফিরতি যাত্রায় গণপরিবহন না থাকায় ও অন্যান্য বাহনের সংকট থাকায় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
ঢাকার কাকরাইল থেকে আসা মুসুল্লি আজিজুর রহমান জানান, ফিরতি পথে তিনি কোন যানবাহন পাননি। তিনিসহ অধিকাংশ মানুষ পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছেন।
গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, আখেরি মোনাজাতের আগে দলে দলে মানুষ ইজতেমার উদ্দেশে এসেছিলেন। মোনাজাত শেষে সবাই একসঙ্গে ফিরতে শুরু করায় যানবাহনের সঙ্কট ও সড়কে মানুষের চাপ অত্যধিক বেড়েছে। ফলে একদিকে যেমন গাড়ির সঙ্কট, ফিরতি পথে গুণতে হচ্ছে বেশি ভাড়া।
এছাড়া আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে ময়দান ও আশপাশের এলাকা জুড়ে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা। মুসুল্লিদের আসা যাওয়া নির্বিগ্ন করতে তৎপর ছিল পুলিশ। এদিন ফিরতি যাত্রায় রেলওয়ে বেশ কয়েকটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে। মুসুল্লিগণ এসব ট্রেনে নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা করেছেন। অনেকে ভিতরে জায়গা না পেয়ে ট্রেনের ছাদে ও দরজায় ঝুলে ঝুকিয়ে যাত্রায় সামিল হয়েছেন।
এবারের বিশ্ব ইজতেমায় বাধ্যক্যজনিত ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মোট ৭ জন মুসুল্লীর মৃত্যু হয়েছে।
আখেরী মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে এবারের ইজতেমার মাওলানা যোবায়ের পন্থী গ্রুপের (প্রথম পর্ব) বিশ্ব ইজতেমা। আগামী ১৭ জানুয়ারি প্রশাসনের মাধ্যমে ইজতেমা ময়দান বুঝে নিবে মাওলানা সাদ অনুসারী গ্রুপ। তারপর ময়দান পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য প্রস্তুতি শেষ করে চারদিন বিরতি দিয়ে আগামী ২০ জানুয়ারী শুরু হবে সাদ অনুসারী গ্রুপের বিশ্ব ইজতেমার (দ্বিতীয় পর্বের) আয়োজন।