গণবাণী ডট কম:
বিশ্ব শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় শেষ হলো মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত তাবলীগ জামাতের ২০২৩ সালের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা। আখেরি মোনাজাতে ঈমানি জিন্দেগী, ইমানি মৃত্যু, উত্তম আখলাক, ইমানি হাকিকত বুঝার তৌফিক, অন্তরে আল্লাহর ভয় ও মহব্বত সৃষ্টি, সারা জীবনের গোনাহ থেকে মুক্তি, উত্তম রিজিক, দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবি, পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ, ঈমানি ভ্রাতৃত্ব মজবুত করা ও বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ চাওয়া হয়।
রোববার দুপুর ১২টা ১৬ মিনিটে শুরু হওয়া মোনাজাত চলে দুপুর দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী মোনাজাতে আল্লাহর কাছে নিজেদের অন্তরের খাহেশাত মুক্ত, রাগকে বশ, নাফরমানিকে ঘৃণা, ভালোবাসা ছড়িয়ে বিশ্ব মুসলিম ভাতৃত্ব গড়া ও দ্বীনের জন্য নিজেদের কবুল করার বিশেষ আর্জি জানানো হয়। বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন ইজতেমার শীর্ষ মুরুব্বি দিল্লীর হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দলাভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী। এসময় গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরের ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় নেমে আসে নীরবতা। এসময় অনেক মুসুল্লি কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুসল্লিদের কান্নাজড়িত কন্ঠে মোনাজাতে মাঝে মাঝে লাখ মুসুল্লির আমিন-আমিন-আল্লাহুম্মা আমিন ধ্বনিতে পুরো এলাকায় এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সকাল থেকে আসা লাখ মুসুল্লি ময়দানে জায়গা না পেয়ে আশপাশের মহাসড়ক-সড়কে, খোলা মাঠে পত্রিকা, চট, পাটি, পলিথিন, ত্রিপল বিছিয়ে বসে আখেরি মোনাজাতের শরিক হন। এছাড়াও বিভিন্ন যানবাহনের ছাদ, বাড়ি ও কলকারখানার ছাদ, তুরাগ নদে নৌকায় বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। আখেরি মোনাজাতে পুরুষের পাশাপাশি আশপাশের সড়ক ও খালি জায়গায় বসে বিভিন্ন বয়সের নারী ও শিশুরাও অংশ নেয় আখেরি মোনাজাতে। কষ্ট হলেও মোনাজাত শেষে সকলের মুখে ছিল প্রাশান্তির ছাপ।
মোনাজাতের শুরুতে সুরা আলে ইমরান থেকে তেলাওয়াত করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী। দয়াময় আল্লাহর নামে হামদ পাঠ করা হয়। মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি, নিজ নিজ গুনাহ মাফ, সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত ও রহমত প্রার্থনা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় লাখো মুসল্লি দু-হাত তুলে আকুতি জানান হয়।
আখেরী মোনাজাতের আগে বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মুরসালিন। আর হেদায়াতি বয়ান করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী। তাদের বয়ান বাংলায় তরজমা করবেন মাওলানা জিয়া বিন কাসিম।
তাবলিগ জামাতের বিবদমান বিরোধের কারণে এবারও বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম পর্বে (১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারী) অংশ নিয়েছিলেন জুবায়েরপন্থী মুসল্লিরা। দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিয়েছেন (সাদ কান্ধলভির) অনুসারীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ইজতেমা ময়দান ও এর আশপাশের তিনটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখে জিএমপি। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার রাত ও রোববার টঙ্গীর তুরাগ তীরে অবস্থান নেন লাখো মুসল্লি। ইজতেমার মাঠে জায়গা না থাকায় বিভিন্ন সড়কে বসে পড়েন মুসল্লিরা। টঙ্গীর মন্নু গেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী বাজার থেকে স্টেশন রোড, আব্দুল্লাহপুর থেকে কামারপাড়া সড়কে মুসল্লিরা অবস্থান নেন। তাঁরা জায়নামাজ, চাদর ও পাটি বিছিয়ে সড়কে বসে পড়েন। এ ছাড়া টঙ্গীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, ময়দানের আশপাশের এলাকায়, বাসার ছাদে মুসল্লিরা অবস্থান করেন।
ইজতেমার আয়োজক কমিটির গণমাধ্যম সমন্বয়কারী মো.সায়েম বলেন, ‘আজ আখেরি মোনাজাতে প্রায় ১২-১৩লাখ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটেছে। স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে ময়দান থেকে প্রায় ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে মাইকের ব্যবস্থা করা হয়। তিনি আরো জানান, এবারের ইজতেমা নতুন যে সমস্ত জামাত বন্দি হয়েছে, তারা আজ থেকে তাবলীগের মুরুব্বিদের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে ও বিদেশে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়বেন। এভাবে আগামী বছরের ইজতেমায় আবায় মিলিত হবেন।
সাভার এলাকা থেকে ময়দানের উত্তর পশ্চিম পাশে কামারপাড়া এলাকায় অবস্থান নিয়েছে কামরুজ্জামান সেলিম। তিনি বলেন, দুই বছর ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই বন্ধুদের নিয়ে সকালেই এসেছি মোনাজাতে। পেপার বিছিয়ে বসে আছি।মোনাজাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি।তিনি নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।
যানবাহনে ধীরগতি,ফিরতি পথে ভোগান্তি :
দ্বিতীয় পর্বের মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই মোনাজাত শেষে বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও রেল রুটে মুসুল্লিদের ঢল নামে। বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়া মুসল্লিরা একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা করেন। তারা ‘আল্লাহু আকবর’ জিকিরের সহিত দলে দলে সড়ক-মহাসড়ক ধরে বাড়ি ফির শুরু করেন। এতে টঙ্গীর আশেপাশের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-আশুলিয়াসহ অন্যান্য সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। এদিকে অতিরিক্ত মানুষ ও যানবাহনের চাপে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও আশপাশের সড়কে যানবাহনে ধীরগতি রয়েছে। মাঝেমধ্যে লেগে যাচ্ছে যানজট। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে উঠেছেন ট্রেনের ছাদে। গাজীপুর ও ঢাকার আশপাশের এলাকার মুসল্লিরা যানবাহনের অপেক্ষায় না থেকে পায়ে হেঁটেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। আবার অনেকেই বাসে ও পিকআপ ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফিরছেন। এছাড়া যারা কোন যানবাহন পেয়েছেন তাদের গুনতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। ফলে মুসল্লিরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে।
রাজধানী ঢাকার মহাখালী ও টঙ্গী হয়ে কালীগঞ্জ এবং ভৈরব রোড, ময়মনসিংহ রোড, টাঙ্গাইল রোড, শেরপুর রোড, কিশোরগঞ্জ রোড এবং গাজীপুর রোডের যাত্রীবাহী বাসগুলো কয়েকগুণ হারে নিজেদের ইচ্ছে মতো বেশী ভাড়া আদায় করছে বলে একাধিক মুসল্লি অভিযোগ করেছেন।
টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ থেকে গাজীপুর চৌরাস্তার ভাড়া ২০-২৫ টাকা হলেও মোনাজাতের পর রওনা হওয়া যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ১০০ টাকা। এ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছে ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা।
জিএমপি কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, সকলের সহযোগীতায় এবারের দুই পর্বের ইজতেমা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বরাবরে মতো এবারও কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ইজতেমা মাঠ নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে প্রায় সাড়ে ৫ হাজারের মতো বিদেশী অতিথির জন্য বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমাও সম্পন্ন হয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা সুষ্ঠু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পেরে সকলেরপ্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ জানান, ইজতেমায় জরুরী সেবা প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিক গার্বেজ ট্রাকসহ প্রায় ৬০০ পরিচ্ছন্নকর্মী মোতায়েন ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিারা যেন শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমায় আল্লাহর ধ্যানে সময় ব্যায় করতে পারে।
এবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিতে আসা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৬ জন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।