গণবাণী ডট কম:
চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি গ্রেফতার হওয়ার সোয়া সাত ঘন্টা রুদ্ধশ্বাস ও নানা নাটকীয়তার পর শনিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার আনোয়ারুল করিম মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, শনিবার সন্ধ্যায় মাহির জামিনের কাগজপত্র কারাগারে এসে পৌঁছায়। পরে জামিনের কাগজপত্র যাচাই শেষে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। কারা ফটকে মাহিয়ার পিতা-মাতা তাকে গ্রহণ করেন।
এসময় সাংবাদিক ও বিপুল সংখ্যক উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে মাহিয়া মাহি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে পারেননি।
এর আগে শনিবার বেলা পৌনে বারোটার দিকে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিমানে দেশে ফেরার পর ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করে গাজীপুর মহানগর পুলিশের বাসন থানা পুলিশ। চাঁদাবাজি ও মারধর করা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা পৃথক দুটি মামলায় মাহিয়া মাহিকে গ্রেফতার করা হয়। পরে মাহিকে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি আদালতে তোলা হলে দুপুরে একবার শুনানি শেষে তার জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফা জামিনের শুনানি শেষে সন্ধ্যায় মহানগর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেন তার জামিন মঞ্জুর করেন।
প্রথম দফা শুনানী শেষে প্রথমে তাকে জামিন ও রিমান্ড না মঞ্জর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। পরে মাহির আইনজীবিগণ প্রথম শুনানীর সময়ে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি ও দ্রুততার কারণে শুনানীতে অংশ নিতে পারেননি। তাই মাহিয়া মাহির আইনজীবিগণ একই আদালতে পুনরায় জামিন শুনানীর আবেদন করেন। বিঝ্হ আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেন পুনরায় জামিন শুনানী নিতে রাজী হলে শনিবার সন্ধ্যার একটু আগে আগে দ্বিতীয় দফা শুনানী নিয়ে মাহির জামিন মঞ্জর করা হয়।
মাহিয়া মাহির আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান জানান, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মাহিয়া মাহিয়া মাহি আদালতে আত্মসমর্পণ করার জন্যই সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু পুলিশ তাকে আত্মসমর্পণের সুযোগ না দিয়ে বিমানবন্দর থেকেই শনিবার পৌনে বারোটার দিকে তাকে গ্রেফতার করে। পরে পুলিশ তাকে কড়া প্রহরায় আদালতে উপস্থাপন করে দ্রুত কার্যক্রম শেষ করে। এ সময় আসামীর পক্ষের আইনজীবীগণ কথা বলার সুযোগ পাননি। এ কারণে আদালত মাহিয়া মাহিকে জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ প্রদান করেন।
তিনি আরো জানান, পরে বিষয়টি তারা বিজ্ঞ আদালতের নজরে আনেন এবং পুনরায় শুনানি করে মাহিয়া মাহিকে জামিন দানের আবেদন করেন। শনিবার সন্ধ্যার আগে আগে আদালতে দুটি মামলায় মাহিয়া মাহির জামিনের উপর শুনানী হয়। এ সময় আইনজীবীগণ মাহিয়া মাহির জামিনের জন্য তিনটি যুক্তি উপস্থাপন করেন।
এগুলো হলো, মাহিয়া মাহি একজন নারী। তিনি স্বনামধন্য একজন অভিনেত্রী। তিনি ৭ মাসের অন্ত:স্বত্মা। আদালত এসব বিষয়ে সন্তোষ্ট হয়ে ৫শ টাকার বন্ডে মাহির জামিন মঞ্জর করেন।
ঘটনার শুরু হয় গত শুক্রবার ভোরে মাহিয়া মাহির ফেসবুক পেজ থেকে মাহির স্বামী রাকিব সরকারে একটি লাইভ থেকে। স্বামীর সঙ্গে ওমরাহ পালন করতে যাওয়া চিত্রনায়িকা মাহী সৌদি আরবের মক্কা শহর থেকে ফেসবুক লাইভে রকিবের গাড়ির শো-রুম ভাঙচুর ও হামলার অভিযোগ করেন।
এ সময় তিনি দাবি করেন, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের পূর্ব পাশে ‘সনিরাজ কার প্যালেস’ নামে তার স্বামীর একটি গাড়ির শোরুম রয়েছে। সেই শোরুমে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীরা তার শোরুমের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা শোরুমের বিভিন্ন আসবাব, দরজা-জানালার কাচ, টেবিল-চেয়ার ভাঙচুর করেছে। শোরুমের সাইনবোর্ডও খুলে ফেলেছে। দুর্বৃত্তরা তার অফিসকক্ষ তছনছ করে টাকাপয়সা লুট করে নিয়ে গেছে।
ইসমাইল হোসেন ওরফে লাদেন ও মামুন সরকারের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করেন মাহি।
এসময় ফেসবুকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বিরুদ্ধে দেড় কোটি টাকা ‘ঘুষ’নেওয়ার অভিযোগ তোলেন মাহী।
অন্যদিকে, মাহীর ফেসবুক লাইভের পর শুক্রবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করেন বাসন থানার দিঘীরচালা এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগী ইসমাইল হোসেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেন, রকিব সরকার তার প্রায় সোয়া ১১ শতাংশ জমি দখল করে গাড়ির শো রুম করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে জমি উদ্ধার ও তাদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের তিনি অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি মীমাংসার জন্য দফায় দফায় চেষ্টাও করা হয়। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে ওই শো রুমে নতুন কিছু গাড়ি উঠাতে থাকে রকিব সরকারের লোকজন।
ইসমাইল বলেন, খবর পেয়ে সেখানে আমিসহ কয়েকজন হাজির হই। এ সময় দেশীয় অস্ত্রসহ রকিব সরকারের লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়। নিজেরাই নিজেদের শো রুম ভাঙচুর করেছে। এ ঘটনায় আমিসহ ৩ জন লোক আহত হই। ওই জমি রকিব সরকারের নয়।
তিনি আরও বলেন, জমি ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে রাকিব সরকার আমার কাছে এক কোটি টাকা দাবি করেছিলেন। যেখানে এক কোটি টাকা দিলে সমস্যা সমাধান হয়, সেখানে কেন আমি পুলিশকে দেড় কোটি টাকা দেব? পুলিশ আমার পক্ষে থাকলে আজ কেন আমি মার খেলাম? কেন মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দিলাম ? গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই রকিব তার স্ত্রী চিত্রনায়িকা মাহীকে ব্যবহার করছেন।
এর পরেই শুক্রবার রাতে জমি দখল ও পুলিশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্নের অভিযোগে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহী ও তার স্বামী রকিব সরকারের বিরুদ্ধে গাজীপুরের বাসন থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়। মামলা দায়ের করার পর ফেসবুকে মাহি ও তার স্বামী দেশে ফিরলে গ্রেফতারের আশংকা প্রকাশ করে পোস্ট করেন।
শনিবার সকালে জিএমপি কমিশনারকে নিয়ে ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণার বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করেন কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম। বেলা ১২টার দিকে সম্মেলন শুরুর আগেই খবর আসে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহীকে শনিবার বেলা পৌণে ১২টার দিকে হযরত শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পরে শনিবার দুপুর পৌণে ১টায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম শো রুমে হামলা, পাল্টা অভিযোগ, মামলা এসব নিয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, শুক্রবার রাতে দায়ের হওয়া দুটি মামলায় মাহিয়া মাহীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে আজই আদালতে পাঠানো হবে। তিনি আরো জানান, মাহির প্রতিপক্ষের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত আরো ৮জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো, সাজ্জাদ হোসেন সোহাগ (৩৮), আশিকুর রহমান (৩২), ফাহিম হোসেন হৃদয় (২২), জুয়েল রহমান (২৫), জমশের আলী(৪৪), মোস্তাক আহমেদ(২২), খালিদ সাইফুল্লাহ জুলহাস(৩০), সুজন মন্ডল(৩৪) ও মাহবুব হাসান সাব্বির (১৮)।
সংবাদ সম্মেলন চলাকালেই মাহি ও অন্য আসামীদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
কমিশনার বলেন, মাহিয়া মাহীর স্বামী রাকিব সরকারের বিরুদ্ধে এর আগে অস্ত্র, হত্যা ও ধর্ষণের তিনটি মামলা রয়েছে। ওই মামলাগুলোতে কেউ সাক্ষী দেয়নি কিন্তু ঘটনা সত্য ছিল। তবে এখন মামলাগুলো পুনরায় তদন্ত ও সাক্ষী প্রমাণ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া রাকিব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়িত আমাদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। তার আরেক ভাই গাজীপুরের পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি ও দখলের ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। আমরা গাজীপুরবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহাসড়ক থেকে অননুমোদিত ও অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এতে সড়কে স্বাভাবিক গতি ফিরে এসেছে।
কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চিত্র নায়িকা মিথ্যা বলে মানুষের সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করেছেন তিনি। তারা পুলিশকে বিতর্কিত করার মিশনে নেমেছেন। অথচ মাহী বা তার স্বামী জমিজমা সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে আমার কাছে আসেননি। আজ যাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেছেন, তাদেরও আমি চিনি না।
জানা যায়, শনিবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে মাহিয়া মাহি সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি বিমানবন্দর থেকে হুইল চেয়ারে করে বের হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর বিমান বন্দর থেকে সরাসরি মাহিকে দুপুরে আদালতে তোলা হয়। এসময় মাহির পরণে ছিল কালো বোরকা মাথায় কালো স্কার্ফ। জনাকীর্ণ আদালতে খুব দ্রুত মাহির বিষয়ে শুনানী শেষে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে তাকে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রথম দফা শুনানী শেষে কারাগারের পাঠানোর প্রায় ৪ ঘন্টার মাথায় মাহি জামিন লাভ করেন। আদালতে মাহির পক্ষে শুনানীতে অংশ নেন এ্যাডভোকেট আনোয়ার সাদাত, কামরুল হাসান, রিপন চন্দ্র সরকার ও নবীরুল ইসলাম।
জামিন মঞ্জুরের পর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় এ্যাডভোকেট কামরুল হাসান বলেন, বিজ্ঞ আদালত জামিন মঞ্জর করায় আমরা খুশী। আশা করছি, বেল বন্ড স্বাক্ষরের পর আজ শনিবারেই মাহিয়া মাহি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করবেন।
পুলিশকে জড়িয়ে ফেসবুকে প্রচারণার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা মাহির সাথে কোন বিষয় নিয়েই কথা বলতে পারিনি। তিনি মুক্তি পেলে আমরা বিস্তারিত জেনে পরে সবকিছু জানানো হবে।