গণবাণী ডট কম:
আর মাত্র ১৪ দিন পর গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ভোট। কিন্তু ভোটের পরিবেশ, কালো টাকার প্রভাব, সুষ্ঠ ভোট হওয়া এবং ইভিএম নিয়ে নির্বাচনের প্রার্থী ও ভোটারদের শংসয় কাটেনি। ভোট দিলে পছন্দের প্রার্থীই ভোট পাবেন কি না এসব নিয়ে প্রার্থী ও ভোটারের মধ্যে রয়েছে নানা প্রশ্ন ও সংশয়। বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মতবিনিময় সভায় প্রার্থীরা এমন শংকার কথাই জানালেন। এসময় এক মেয়র প্রার্থী বলেন, ইভিএম-এ তাল গাছের ভোট বেল গাছে যাবে না তো? আরেক প্রার্থী জানতে চান ভোট সুষ্ঠু করতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করবেন কি না?
আগামী ২৫ মে সিটি নির্বাচনের ভোট হবে। এ উপলক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সাথে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল মতবিনিময় করেন। এতে নির্বাচনে অংশ নেয়া সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ও সাধারণ কিউন্সিলর এবং মেয়র প্রার্থীগণ অংশ গ্রহণ করেন।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করা আমাদের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এটা ঠিক, এককভাবে আমরা তেমন কিছুই করতে পারবো না। যদি আমাদের সহযোগী প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন তাদের দায়িত্ব শক্তভাবে এবং পেশাগত ভাবে পালন না করে।
এতে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোঃ ফরিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর, নির্বাচন কমিশনের সচিব মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মোঃ সাবিরুল ইসলাম, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান।
অনুষ্ঠানে গাজীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এস কামরুল হাসান প্রচার প্রচারণা বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় তিনি সচিত্রভাবে সবাইকে জানান প্রার্থীগণ দখল করে নির্বাচনী ক্যাম্প সাপোর্ট করেছেন প্লাস্টিকের কভারযুক্ত পোস্টার প্রচারণা ব্যবহার করছেন মাইক ব্যবহার করছেন এবং তরুণ নির্মাণ করছেন। তিনি বলেন এসব আচরণব্যাধি সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এসব করার কারণে নগরবাসীর নানা রকম দুর্ভোগ হচ্ছে তিনি প্রার্থীদের এসব না করার আহ্বান জানান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে নগরীর সাধারণ ও ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরা রাতের আঁধারে নির্বাচনে যে কালো টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে তা বন্ধের দাবি জানান। তারা শেষ দুই তিন দিন যে কালো টাকার ব্যবহার হবে তা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তারা বলেন, গত নির্বাচনে আতঙ্ক ছাড়ানোর জন্য মানুষজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি এবার তা বন্ধের দাবি জানান। তারা বলেন, নির্বাচনে কালো টাকা ব্যবহারের কারণে ভোটার প্রতি ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করা হচ্ছে এবং টাকা দিয়ে তারা ভোটার আইডি কার্ড নিজেদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে দাবি করেন। সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১২ নারী কাউন্সিলর প্রার্থী অভিযোগ করেন, তিনি ভোটারদের কাছে গেলে বলেন ওমুক প্রার্থী আমাকে এত টাকা দিচ্ছে তুমি কত টাকা দিবে তাই তিনি কালো টাকা বন্ধের দাবি জানান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মেয়র পদে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান বলেন, আজকে বাংলাদেশের প্রধান সংকট নির্বাচন মানুষ ভোট দিতে পারে না। বিগত নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারে নাই। আমরা আপনাদের কাছে সুষ্ঠু ভোট আশা করি। যদি কমিশন নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে আপনারা কি করবেন আমি কমিশনের নিকট এটি জানতে চাই। এই সময় তিনি বলেন, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আপনারা ব্যর্থ হন তাহলে আপনারা পদত্যাগ করবেন কি? আজকে এই ঘোষণা দিতে হবে। এ সময় তিনি ইভিএম নিয়ে ভোটে আপত্তি জানিয়ে বলেন, ইভিএম আমরা পরিবর্তন চেয়েছিলাম। তিনি আরো বলেন, কোন দলীয় লোক যাতে প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ করা হয় এজন্য তিনি অফিসারদের পরিচয় প্রকাশের দাবি জানান।
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী শাহনুর সরকার রনি বলেন, ২০১৮ সালের গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গাজীপুরবাসী ভালো করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাক্ষী আছে, সেই নির্বাচনে কিভাবে আমার চাচার (হাসান উদ্দিন সরকার) এজেন্টদেরকে নির্বাচনী কেন্দ্রে থাকতে দেওয়া হয়নি। তাদেরকে কিভাবে অপহরণ করে অন্য জেলায় নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সময় আমরা রিটার্নিং অফিসারের নিকট অভিযোগ করেছি, তারা কোন প্রতিকার মুলক ব্যবস্থা নেয়নি। তাই আমি আজ জানতে চাই, যদি ২০১৮ সালের সেই নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে নির্বাচন কমিশন কি ভূমিকা পালন করবে আমি সেই প্রশ্ন রাখছি।
জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী, সাবেক সচিব এম এম নেয়াজউদ্দিন বলেন, আমি বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগে যাচ্ছি, মানুষ সংখ্যা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করছে। অতীতে নির্বাচন নিয়ে অনেক অনিয়ম হয়েছে। ইভিএম নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ভোটাররা জানতে চান, আমি তাল গাছে ভোট দিলে বেল গাছে চলে যাবে না তো ? মানুষজন এমন প্রশ্ন করেন। এই প্রশ্নগুলোর কারণ, আপনারা জানেন বিগত দিনের অনেকগুলো নির্বাচন মানুষের কাছে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। ১৮ সালের ভোটে পুলিশ প্রশাসন প্রার্থীর এজেন্টদেরকে বের করে দিয়ে নিজেরা সীল মেরেছে, কখনো সিভিল প্রশাসনকে এভাবে কাজ করতে দেখি নাই।
তিনি বলেন, কালো টাকার কথা অনেকে বলেছেন। আইনে আছে কালো টাকা যারা ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিগত কোনদিন আমরা দেখি নাই যারা কালো টাকা বিতরণ করে তাদের বিগত কোনদিন আমরা দেখি নাই। যারা কালো টাকা বিতরণ করে তাদের ধরা হয়েছে। কে ধরা হয়েছে অর্থাৎ কাজের গরু খাতায় আছে গোয়ালে নাই আপনার আইন আছে আপনারা প্রয়োগ করতে। যারা কালো টাকা ব্যবহার করে তাদের শাস্তি দিন মানুষকে বুঝান প্রশাসন নিরপেক্ষ।
মতবিনিময় সভায় প্রার্থীদের বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেন নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর। তিনি বলেন, ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে যাওয়া একটি অপরাধ। এ ধরনের কোনো অভিযোগ থাকলে, সুনির্দিষ্ট ভাবে আমাদের জানালে আমরা ব্যবস্থা নিব। তারপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ভোটার আইডি কার্ড না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। ভোটকেন্দ্রে গেলে আপনার আঙ্গুলের ছাপ অথবা যদি ভোটার নাম্বার বলতে পারেন তাহলে আপনি ভোট দিতে পারবেন।
তিনি আরো বলেন, কালো টাকা বিতরণের বিষয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছে। আপনি প্রমাণসহ আমাদের বলেন, আমরা ব্যবস্থা নেব। কারণ প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। টাকা বিতরণের ভিডিও অডিও অথবা কোন ছবি আমাদেরকে দিবেন, তাহলে অবশ্যই নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবে।
তাল গাছে ভোট দিলে বেল গাছে চলে যায়- এই মন্তব্যের জবাবে কমিশনার বলেন, ইভিএম এর ভোট এক জায়গায় দিলে আরেক জায়গায় চলে যায় এটি সত্য নয়। তাহলে সব জায়গায় সরকারি দলই জিততো। অন্য দলের বোর্ড জন্য দলের লোক ভোটে জিততো না। সময় তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী প্রথম হয়েছেন এবং সরকারি দলের প্রার্থী চতুর্থ হয়েছেন ইভিএমে এ ধরনের কিছু করার সুযোগ নেই এবং ধরনের অপপ্রচার যারা করেন তাদের অসৎ উদ্দেশ্য থাকে তারা সেই উদ্দেশ্যেই এটা করেন। তিনি আরো বলেন, ইভিএমে ভোট হবার আগে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে কিভাবে ইভিএম এ ভোট দিতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
কালো টাকার ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকা না দিলে ভোট দেবো না, যদি এমন কথা কোন ভোটার বলে থাকেন, তাহলে সেটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেটা যদি প্রমাণ সহকারে দিতে পারেন, তাহলে আইনানকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, ভোটারকে যদি ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া হয় সেটা অত্যন্ত বড় বড় অপরাধ। কমিশনন এ ব্যাপারে জিরো ট্রলারেন্স। যদি নির্বাচন কমিশনার, রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে কাছে কোন অভিযোগ আসে, যেই প্রার্থীর কর্মী বা সমর্থক এই অপরাধ করবে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হবে। এমন অপরাধে কেউ যদি জড়িত হয় এবং তিনি যদি নির্বাচিত হন, তাহলে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে সেখানে পুনরায় নির্বাচন দেওয়া হবে।
কমিশনার আলমগীর তার বক্তব্যে দুজন মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ব্যর্থ হলে কমিশন পদত্যাগ করবেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনারা অতীতে দেখেছেন নির্বাচন সুষ্ঠ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বাতিল করা হয়েছে। গাজীপুরের ক্ষেত্রেও যদি একাধিকবার নির্বাচন অনিয়ম হয় তাহলে একাধিকবার নির্বাচন বাতিল করা হবে পুনরায় নির্বাচন করা হবে।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করা আমাদের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এটা ঠিক, এককভাবে আমরা তেমন কিছুই করতে পারবো না। যদি আমাদের সহযোগী প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন তাদের দায়িত্ব শক্তভাবে এবং পেশাগত ভাবে পালন না করে।
তিনি বলেন, আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, জেলা পুলিশ এবং মহানগর পুলিশের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে মহানগর পুলিশ কমিশনারকে আইনগতভাবে অতিরিক্ত কিছু ক্ষমা দাও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাই পুলিশ প্রশাসনকে পুলিশ কমিশনার মহোদয় আপনাকে কাজেই পুলিশ কমিশনার সাহেব আপনাকে এর দায়িত্ব যোগ্যতার সাথে আন্তরিকতার সাথে নিরপেক্ষতার সাথে পালন করতে হবে। নির্বাচনের সময় আপনাদের দায়িত্ব আমরা দৃষ্টি রাখবো আমরা অভিযোগ শুনবো তদন্ত করে দেখব নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে হবে। আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতা থাকতে হবে আপনাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকতে হবে আমরা সহিংসতা করব না উশৃঙ্খলতা করবো না তাহলেই এই নির্বাচনটা উৎসবমুখর হতে পারে।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন বাংলাদেশ নির্বাচনের দিকে সারা পৃথিবী তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আমাদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে আমরা কিন্তু তাদের মুখ চেপে ধরতে পারছি না যদি সম্ভব হতো মুখ চেপে ধরতাম কিন্তু মোট চেপে ধরতে পারবো না পৃথিবীটা এখন উন্মুক্ত এখন গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড আমাদের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা কথা বলছে ইউকে কথা বলছে ইউরোপীয় কান্ট্রি কথা বলছে জাপান কথা বলছে এবং জাতিসংঘ কথা বলছে কাজেই আমরা গাজীপুর যে নির্বাচনটা হবে এটার গুরুত্বটা আমাদের কাছে নির্বাচন কমিশনের কাছে অত্যধিক কারণ আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার আগে এত বড় পরিসরের একটা নির্বাচন জাতীয়ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বহন করে বলে আমরা মনে করি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, কালো টাকা নিয়ে খুব মাথা ঘামাবেন না। কালো টাকা যতই বিতরণ করা হোক, যদি দেখেন কন্ট্রোল করতে পারছেন না, তাহলে কালো টাকা গ্রহণকারীদের বলে দেবেন, ভাই কালো টাকা নিলে নিবেন। ভোটটা কিন্তু সঠিকভাবে দিয়েন। আপনি যাকে বিশ্বাস করেন, যাকে ভাল মনে করেন, তাকে ভোট দেবেন। কারণ ভোট দেওয়ার সময় কালো টাকা দিয়েছে, সে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে না। কেউ দেখবে না। ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমার স্বচ্ছতা যদি থাকে, স্বাধীনতা যদি থাকে, তাহলে কালো টাকা জোর করেও আমাকে দিলে বা আমি টাকা নিয়েছি, আমি টাকা খেয়ে ফেলেছি, সেটা ভোটে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।