গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীতে পিটিয়ে শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলামকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। দীর্ঘ ৮ মাস তদন্ত শেষে গেল শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টায় অনলাইনের মাধ্যমে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
অভিযোগপত্রে টঙ্গীর প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক (অ্যাডমিন ম্যানেজার) আবু সালেহ (৩৯) ও স্থানীয় প্রভাবশালী কামরুলের ভাই আমির হোসেন (৪০) সহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা রয়েছে। প্রথমোক্ত দুই জনের ইশারাতেই শহিদুলকে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে পুলিশ।
অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত অপর আসামীরা হলো, মাজাহারুল ইসলাম (৩৫), আকাশ আহম্মেদ ওরফে বাবুল (৪৩), রাসেল মণ্ডল (৩৫), রাইতুল ইসলাম ওরফে রাতুল (১৯), সোহেল রানা (২৩), জুলহাস আলী (২৩), সোহেল হাসান সোহাগ (২৬), শাহীনুল ইসলাম (২১), শাকিল মোল্লা (২৩), মো. হালিম মিয়া (৪২), মো. রফিকুল ইসলাম (৪৬), জুয়েল মিয়া (২২)।
গত বছরের ২৫ জুন টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ি এলাকার ‘প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড’ নামের কারখানায় শ্রমিকদের পাওনা টাকা আদায় সংক্রান্ত আলোচনা করার জন্য ঐ কারখানায় গিয়ে মালিক-শ্রমিকদের সাথে কথা বলে ফিরে আসার পথে সন্ত্রাসীদের হামলার নিহত হন শহিদুল। পরে তাকে তারগাছ এলাকায় তায়রুন্নেছা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরদিন ২৬ জুন টঙ্গী পশ্চিম থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কল্পনা আক্তার। নিহত শহিদুল ইসলাম একই গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও পাওনা বেতন আদায় করে দিতে কাজ করতেন।
মামলার তদন্ত কমিটির সভাপতি ও গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহম্মেদ
অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি আরো বলেন, অভিযুক্তদের মধ্যে আবু সালেহ, আমির হোসেন, মো: হালিম মিয়া পলাতক রয়েছেন। বাকী আসামীরা গ্রেফতার হয়েছেন।
ইমরান আহমেদ আরো বলেন, মামলাটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ছিল। তদন্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী আমির হোসেন ও কারখানার কর্মকর্তা আবু সালেহর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মূলত তাদের ইশারা-ইঙ্গিতেই অন্য আসামিরা শহিদুলের ওপর হামলা চালিয়েছে। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করেই অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা শিল্প পুলিশের পরিদর্শক উসমান গণি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও পাওনা বেতন আদায় করে দিতে কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন মো. মোস্তফা, আক্কাছ ও শরিফ নামে আরও তিন শ্রমিক নেতা। এর মাঝে বিভিন্ন কারখানায় কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁদের সঙ্গে শ্রমিক নেতা মাহাজারুল ও রাসেল মণ্ডলদের বিরোধ বাঁধে। এরপর শহিদুলরা কাজ করতেন নগরের গাছা থানা এলাকায়। মাজাহারুলরা কাজ করতেন টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার বিভিন্ন কারখানায়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, গেল বছরের মে ও জুন মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস বকেয়া থাকায় ২৫ জুন দুপুর থেকে প্রিন্স জ্যাকার্ড কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। পরে কারখানার শ্রমিকরা তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য শহিদুল ও তার সংগঠনের সহযোগিতা কামনা করেন। পরে বিকেলেই কারখানাটির শ্রমিকদের পাওনা আদায় নিয়ে কথা বলতে কারখানাটিতে যান শহিদুল, মোস্তফা, আক্কাছ ও শরিফ। তারা কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সাথে আলোচনা শেষ করে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কারখানা থেকে বের হন। পথে স্থানীয় প্রভাবশালী মো. আমির হোসেন ও কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা মো. সালেহর ‘ইশারায়’ অপর আসামীরা শহিদুলদের ওপর চড়াও হয়। এসময় শহিদুলকে মারধর করা হয়। এতে শহিদুল গুরুতর আহত হন। পরে তাঁকে গাজীপুরের তাইরুন্নেসা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় মামলা দায়ের করার পর প্রাথমিক অবস্থায় মামলাটির তদন্ত করে টঙ্গী পশ্চিম থানা-পুলিশ। পরে বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ জুলাই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় গাজীপুর শিল্প পুলিশকে।
স্থানীয়রা জানান, আসামি আমির হোসেন টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার প্রভাবশালী কামরুলের ভাই। তার বিক্রি করা জমিতেই গড়ে উঠেছে প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার কারখানা। আমির হোসেন ওই কারখানায় ঝুট ব্যবসা করতেন।
অপর আসামী হালিম মিয়া আমির হোসেনের ভাই কামরুলের জমি ব্যবসার প্রজেক্ট ইনচার্জ হিসেবে এলাকায় পরিচয় দেন। মাজাহারুল বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানার সাধারণ সম্পাদক। বাকি আসামিরা কেউ শ্রমিক নেতা, কেউ স্থানীয় বাসিন্দা।
পুলিশের অভিযোগপত্রের বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও মামলার বাদী কল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমি মামলাটির বাদী। পুলিশ প্রায় আট মাস পর মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে। আশা করি, ন্যায়বিচার পাব।’
কল্পনা আক্তার আরো বলেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক জড়িত থাকলে কারখানার মালিক জড়িত থাকে না কীভাবে? আসামি আমির হোসেন ও হালিম মিয়া প্রভাবশালী জমি ব্যবসায়ী কামরুলের লোক। কামরুলের নির্দেশেই তারা কাজ করতো। কিন্তু অভিযোগপত্রে কামরুল বা কারখানার মালিকের নাম নেই। আমরা এ বিষয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবো।
শহিদুলের স্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, আমার স্বামী কারখানায় গিয়েছিলেন শ্রমিকদের দাবি ও পাওনা আদায়ে মালিকপক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য। সেখানে তার কোনও শত্রু নেই। কারখানা মালিকের একজন লোক রয়েছে যার নাম হানিফ। তিনি নিজে ঘটনাস্থলে থেকে তার স্বামী শহিদুলকে হত্যা করিয়েছে। পরে পুলিশ হালিম নামে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। তাহলে যেই হানিফ আমার স্বামীকে হত্যা করিয়েছে সেই হানিফ কোথায় গেলো? আমার কাছে এ প্রশ্নগুলো শুধু ঘুরপাক খায়।
তিনি বলেন, আমি জীবনে আর আমার স্বামী পাবো না, আমার বাচ্চারা আর তাদের বাবা পাবে না। আমার স্বামীকে কারা মারছে, কেন মারছে, কার ইন্ধনে মারছে? আমার স্বামীকে ইন্ধন ছাড়া মারেনি। আমি চাই সঠিক তদন্ত হোক। নামের সঙ্গে মিল তৈরি করে প্রকৃত আসামিকে যেন লুকানোর চেষ্টা করা না হয়।
নিহত শহিদুল ইসলামের ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র সাদিকুল ইসলাম অপূর্ব সাংবাদিকদের জানান, তার বাবার প্রকৃত হত্যাকারীরা যেন আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। তাদের যেন সুষ্ঠু বিচার ও সঠিক দণ্ড হয়।