ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোটে মধ্যমপন্থী আইনপ্রণেতা মাসুদ পেজেশকিয়ান জয়ী হয়েছেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্ধী কট্টরপন্থী সাইদ জালিলিকে হারিয়েছেন।
নির্বাচনে তিন কোটির বেশি ভোট গণনা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মাসুদ পেয়েছেন ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে, জালিলি পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মাসুদ পেজেশকিয়ান সাবেক পারমাণবিক আলোচক সাইদ জালিলিকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গমাধ্যমের খবরে বলা হয়, শনিবার ভোর হতেই মাসুদ পেজেশকিয়ানের সমর্থকরা তেহরানসহ বিভিন্ন শহরে নেমে আসে এবং উল্লাস শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, মাসুদের সমর্থকরা ইরানজুড়ে বিভিন্ন রাস্তায় নেচে উদযাপন করছেন।
নির্বাচন কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র মোহসিন ইসলামি বলেছেন, তিন কোটির বেশি ভোট গণনা হয়েছে। এর মধ্যে মাসুদ পেজেশকিয়ান পেয়েছেন ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি ভোট। আর সাইদ জালিলি পেয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি ভোট। মোট ৪৯.৮ শতাংশ লোক ভোট দিয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। এই প্রেক্ষিতে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানান।
প্রথম দফার ভোটে মাসুদ পেজেশকিয়ান ৪২ শতাংশ ভোট এবং জালিলি পেয়েছেন ৩৯ শতাংশ ভোট। প্রথম দফায় ৬ কোটি ১০ লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল যা ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর যে কোন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে কম।
প্রথম দফায় পেজেশকিয়ান ও জালিলি ছাড়া আরও দু’জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাঁরা হলেন কট্টরপন্থী পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফ এবং কট্টরপন্থী মোস্তফা পুরমোহাম্মদি। গালিবাফ ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন। আর পুরমোহাম্মদি পেয়েছিলেন ১ শতাংশের কম ভোট।
উল্লেখ্য, ইরানে আগামী বছরের জুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের চার বছরের মেয়াদ শেষে ভোট অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু গত ১৯ মে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হলে পদটি শূন্য হয়। ফলে আগাম নির্বাচনের বিকল্প ছিল না।
সংবিধান অনুযায়ী, ৫০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এদিকে পেজেশকিয়ান দেশটিতে দীর্ঘ দিনের ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব পরার বিষয়টি দেখার জন্যে পুলিশের টহলেরও ঘোর বিরোধী। যা পুলিশি হেফাজতে ২০২২ সালে মাশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত।
মাসুদ পেজেশকিয়ান ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাহাবাদে ১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা একজন আজারবাইজানি বা আজেরি এবং মা কুর্দিশ।
মাসুদ পেজেশকিয়ানের বয়স ৬৯ বছর। তিনি হৃদ রোগ বিষয়ক সার্জন। ইরানের পার্লামেন্টে ২০০৮ সাল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। ইরানের প্রধান সংস্কারপন্থী জোট তাঁকে সমর্থন দিয়েছে। সাবেক দুই সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও হাসান রুহানিরও সমর্থন পেয়েছেন তিনি।
মাসুদ আজেরি ভাষায় কথা বলেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে ইরানের বিশাল সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর জন্য কাজ করেছেন। তিনি তাবরিজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল সায়েন্সসের প্রধান হিসবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯৪ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মাসুদ পেজেশকিয়ান তার স্ত্রী ফাতেমা মাজেদি এবং এক কন্যাকে হারান। তবে এরপর আর কখনো বিয়ে করেননি তিনি। একাই তার দুই ছেলে ও আরেক মেয়েকে বড় করেন।
ইরানের রাজনীতে মাসুদের প্রবেশ ঘটে উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে। তিনি সংস্কারবাদী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনের অধীনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পান।
৬৯ বছর বয়সী মাসুদ একজন হার্ট সার্জারি বিশেষজ্ঞ। ২০০৬ সালে তাবরিজ থেকে আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হন মাসুদ। তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চার বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলেন। এরপর তিনি ডেপুটি পার্লামেন্ট স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেন। পশ্চিমাদের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত মাসুদ। তিনি একগুঁয়ে স্বভাবের জন্য পরিচিত, তিনি ইরানের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং দুর্নীতির প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন অনেকবার।
২০১৯ সালে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার জন্য রক্ষীদের ব্যাপক প্রশংসা করেন। সেইসময় মাসুদ বলেছিলেন, এর মাধ্যমে আমেরিকানদের মুখে জোরালো ঘুষি দেওয়া হলো এবং তাদের প্রমাণ দেওয়া হলো যে আমাদের দেশ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না।
২০১১ সালে মাসুদ পেজেশকিয়ান প্রেসিডেন্টের লড়াইয়ের জন্য নাম লেখান তবে পরবর্তীতে তিনি তার প্রার্থীতা তুলে নেন। তবে শেষমেশ জয়ের মাধ্যমে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন তিনি।
সবশেষ ২০২২ সালে পুলিশের হেফাজতে মাশা আমিনির মৃত্যুর বিষয়ে ইরান সরকারের ভূমিকাকে প্রকাশ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
মন্তব্য