গাজীপুর মহানগরীর সদর মেট্রো থানাধীন অভিজাত আবাসিক এলাকা দক্ষিণ ছায়াবিথী এলাকার একটি পরিত্যক্ত জমিতে সোমবার (৮ আগস্ট) সকালে মাটি খননের সময় মাটির নীচ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৬টি আর জে এস গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। পরে বিকালে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা গ্রেনেডগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিস্ক্রিয় করে।
বিস্ফোরণের শব্দে আশেপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এসময় ঘটনাস্থলের আশপাশের স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে দেয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের ডিম লিডার ও সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদুজ্জামান বলেন, গ্রেনেডগুলো খুবই শক্তিশালী ও বিপদজনক। আমাদের দেশের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় এ জাতীয় আর জে এস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছিল।
স্থানীয়রা জানায়, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বাসিন্দা ও সৌদি প্রবাসী আবুল কাশেম বাড়ি নির্মাণ করার জন্য গাজীপুর মহানগরীর সদর মেট্রো থানাধীন দক্ষিণ ছায়াবীথি (জোরপুকুরপাড়) এলাকায় সাড়ে ৩/৪ বছর আগে তিন কাঠা জমি ক্রয় করে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে ফেলে রাখেন। দুই মাস আগে তিনি দেশে ফিরে উক্ত জমিতে বাড়ি নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সোমবার সকালে এখানে স্থানীয় শ্রমিকরা মাটি খনন কাজ শুরু করে। সকাল ৯টার দিকে মাটির খনন করার পর গর্তের মধ্যে একটি মাটির কলস বেরিয়ে আসে। এসময় কলসটি আঘাত লেগে ভেঙে গেলে কলসের ভিতর গ্রেনেড সদৃশ কয়েকটি বস্তু দেখা যায়। পরে বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ এসে পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে, এগুলো পরিত্যক্ত গ্রেনেড। পরে নিরাপত্তার জন্য এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং সীমানা ঘেরা জমির গেটে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।
বাড়ির মালিক আবুল কাশেম বলেন, আমি ৩/৪ বছর আগে জমিটি ক্রয় করি। পরে এখানে মাটি ভরাট করে সীমানা প্রাচীর দেই। দুই মাস আগে দেশে ফিরে ৬ তলা বাড়ি করার কাজ শুরু করি। সোমবার শ্রমিকরা সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে মাটি খোড়ার সময় প্রথমে একটি মাটির কলস পাওয়া যায়। পরে কোদালের আঘাতে কলসটি ভেঙ্গে গেলে গ্রেনেডের মতো বস্তু দেখা যায়। পরে শ্রমিকরা সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিষয়টি আমাকে জানায়। পরে আমি প্রথমেই ৯৯৯ ফোন দেই। পরে নিজে গাজীপুর সদর থানায় গিয়ে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসেন।
এ বিষয়ে সদর মেট্রো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ রাফিউলল করিম জানান, গ্রেনেড সদৃশ কিছু বস্তু পাওয়ার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরীক্ষা করে এগুলো বিস্ফোরক জাতীয় বস্তু ধারণা করা হয়। পরে নিরাপত্তার স্বার্থে আশেপাশের লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং জায়গাটির গেটে তালা দেওয়া হয়। পাওয়া যাওয়া বস্তুগুলো পরীক্ষা করার জন্য ঢাকায় বোম্ব ডিসপোসাল ইউনিটকে খবর দেওয়া হয়।
গ্রেনেড উদ্ধারের খবর পেয়ে গঠনের স্থলে আসেন র্যা ব, পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাগণ।
খবর পেয়ে ঢাকা থেকে বেলা বারোটার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের বোম ডেসপোজাল ইউনিটের টিম লিডার ও সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদুজ্জামানের নেতৃত্বে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের ১৯ সদস্যের একটি দল গঠনাস্থলে আসে। তারা দুটি অত্যাধুনিক রোবট, বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ ঘটনাস্থলে এসে ঘটনাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এসময় আশেপাশের বিভিন্ন বাসা-বাড়ীর লোকজন ও উৎুসক জনতাকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরে কলসের ভিতর থেকে ১৬টি তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করা য়। পরে বিকেল চারটার দিকে এগুলো নিষ্ক্রিয়করণ শুরু হয়। এ সময় হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিয়ে নিরাপদ স্থানে গ্রেনেট গুলোর পর পর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিস্ফোরণের শব্দে আশেপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ সময় আশপাশের এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। বাসার ছেলের কাছে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট প্রস্তুত রাখা হয়।
গ্রেনেড নিস্ক্রিয়করণ শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের ডিম লিডার ও সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদুজ্জামান। এসময় তাথে উপস্থিত ছিলেন, গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার ফাহিম আশজাদ ও সদর মেট্রো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ রাফীউল করিমসহ অন্যরা।
সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদুজ্জামান বলেন, আজ সকাল বেলা আমরা একটা ফোন পাই, গাজীপুর মহানগরের দক্ষিণ ছায়াবিথি এলাকায় মাটি খননের সময় বিস্ফোরক জাতীয় কিছু একটা পাওয়া গেছে। এমন খবর পাওয়া সাথে সাথে দ্রুত আমরা আমাদের টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসি।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে আমরা এসে দেখতে পেলাম, একটি মটকার (মাটির কলসি) ভিতরে প্রচুর শক্তিশালী গ্রেনেড, যাকে আর জে এস গ্রেনেড বলা হয় এধরনের গ্রেনেড রয়েছে। একারণে এ জায়গাটা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। যে কারণে আমরা আমাদের আর ও ভি রোবট (রিমোটলি অপারেটর ভেহিকেল) এই রোবটের মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকটি গ্রেনেড আমরা দেখার চেষ্টা করি। আমরা দেখার চেষ্টা করি গ্রেনেডের পিনগুলো অক্ষত আছে কিনা। কারণ গ্রেনেডের পিন খুলে গেলে এটি খুবই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে আমরা সফলতার সাথে সবগুলো গ্রেনেডগুলো আলাদা করতে সক্ষম হই। পরে আমাদের টিমের দুইজন সদস্য বোম্ব শ্যুট পড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যেকটি গ্রেনেড আমরা আলাদা আলাদাভাবে ডিসপোজ করতে সক্ষম হই।
এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ১৬টি গ্রেনেড ডিসপোজ করেছি। এগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এন্টি পারসোনাল প্রেগমেন্টেশন টাইপ হয়ে থাকে। এটি খুবই শক্তিশালী।
গ্রেনেডগুলো কোন দেশের, কতদিন আগের্ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি কোন দেশের এটি বলা যাচ্ছে না। কারণ গ্রেনেডের গায়ে আমরা কোন মেনোফ্যাকচারিং মার্ক বা এরকম কোন কিছু আমরা পাইনি। গ্রেনেডগুলো অনেক আগের, তাই বলতে পারছি না এটি কোন দেশের তৈরি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে, আর জে এস গ্রেনেড এটা আমাদের দেশে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় এই গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছিল। এটা আসলে পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার আছে। এগুলো আমরা নিয়ে যাব, এটা আমরা ফরেনসিক চেক করব, এটা আমরা বিস্ফোরক অধিদপ্তরে পাঠাবো। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানাতে পারবেন এটি কবে কার গ্রেনেড।
কতদিন আগে এখানে মাটির নিচে এগুলো রেখে দেওয়া হয়েছিল জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এগুলো আমরা দেখে যেটা বুঝেছি, এগুলো অনেক আগের কিন্তু স্পেসিফিক কতদিন আগে এটি আসলে বলা সম্ভব নয়। এটা অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার আছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি গ্রেনেড লাইভ অবস্থায় ছিল। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। গ্রেনেট গুলো একটি মটকার ভিতরে পলিথিনে মোড়ানো ছিল। আমরা বলতে চাই এগুলো সেপারেট করা আমাদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অনেক আগের ছিল একটা আরেকটার সাথে লেগেছিল, তবু আমরা সফলতার সাথে সবগুলো গ্রেনেড ডিসপোজ করতে সক্ষম হয়েছি।
কতদিন আগে কারা এখানে গ্রেনেট গুলো রাখতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আসলে তদন্তের বিষয়। গাজীপুর মহানগর পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থা এটি তদন্ত করবে। তদন্তের আগে এটা আসলে বলা সম্ভব নয়, এটা কত আগের অথবা এটা কোন গোষ্ঠী এই গ্রেনেডগুলো এখানে রেখেছে।
গ্রেনেড কতদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো বিস্ফোরণ অথবা ডিসপোজ করার আগ পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। যে কোনো সময় এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
এখানে উল্লেখ্য, গাজীপুর মহানগরীর দক্ষিণ ছায়াবিথী আবাসিক এলাকার যে জায়গা থেকে গ্রেনেড উদ্ধা্র করা হয়েছে। সে জায়গা থেকে মাত্র দুইশ মিটার দক্ষিণে ফনির টেক এলাকায় রয়েছে, তারেক রহমানের ব্যবসায়ীক পার্টনার গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের একটি ৩ তলা বাড়ী রয়েছে। যার নাম খোয়াব ভবন। এখানে তারেক রহমান যাতায়াত করতেন।
মন্তব্য