যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার নির্বাচনী সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলা ঘটনা ঘটেছে। হামলার পরপরই একজন পুরুষ হামলাকারী সিক্রেট সার্ভিস সদস্যদের গুলিতে নিহত হয়েছে।
মুখের এক পাশে ও কানে রক্ত নিয়ে সিক্রেট সার্ভিস সদস্যদের সহায়তায় সমাবেশস্থল থেকে বেরিয়ে আসার পর মি. ট্রাম্প বলেছেন, তার কানের ওপরের অংশের চামড়া ভেদ করে বুলেট চলে গেছে।
এদিকে, সমাবেশে গুলিতে আহত হবার পর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে নিউ জার্সির বাড়িতে ফিরেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই ইতোমধ্যেই জানিয়েছে যে গুলির ঘটনা ছিলো মি. ট্রাম্পকে ‘হত্যার চেষ্টা’। এ ঘটনায় হামলাকারীর গুলিতে অন্য এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন এবং দুজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
এফবিআই ট্রাম্পের ওপর হামলার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেছে। সিক্রেট সার্ভিস সদস্যদের গুলিতে নিহত হওয়া বিশ বছর বয়সী ওই হামলাকারীর নাম থমাস ম্যাথিউ ক্রুকস।
ট্রাম্প এবং তার কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্প সিক্রেট সার্ভিস ও অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তার ছেলে ট্রাম্প জুনিয়র বলেছেন আমেরিকাকে রক্ষার জন্য লড়াই করা ট্রাম্প বন্ধ করবেন না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মি. ট্রাম্প মেঝেতে বসে পড়ছেন এবং এরপর তিনি যখন দাঁড়ান তখন তার মুখের এক পাশে রক্ত দেখা যাচ্ছিলো।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এ হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকরা ছাড়াও বিশ্ব নেতৃবৃন্দও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
এ ঘটনাটি আমেরিকার ইতিহাস, রাজনীতি ও নভেম্বরের নির্বাচনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাইডেন বলেছেন, এ ধরণের সহিংসতার কোন জায়গা আমেরিকায় নেই। এটা জঘন্য, জঘন্য। আমি নিশ্চিত করতে চাই যে আমাদের কাছে সব তথ্য আছে।
তিনি নিরাপদ ও ভালো আছেন শুনে আমি কৃতজ্ঞ। আমি তার এবং তার পরিবার ও সমাবেশে যারা ছিলেন তাদের সবার জন্য প্রার্থনা করছি। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় জিল ও আমি সিক্রেট সার্ভিসের কাছে কৃতজ্ঞ”।
সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও এক দর্শক নিহত
ট্রাম্পের সমাবেশে এই ঘটনার জন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। একই সাথে সমাবেশে থাকা অন্য এক ব্যক্তিও নিহত হয়েছেন।
স্থানীয় ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি জেনারেল রিচার্ড গোলডিনজার বার্তা সংস্থা এপি ও স্থানীয় গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির সহযোগী সিবিএস -এর খবরেও বলা হয়েছে সিক্রেট সার্ভিস সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পেনসিলভানিয়ার বাটলারে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্য শুরুর পাঁচ মিনিট গুলির শব্দ শোনা যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিক্রেট সার্ভিস সদস্যরা মি. ট্রাম্পকে ঘিরে ফেলেন। তার কানে ও মুখের এক পাশে রক্ত দেখা গেছে। মঞ্চ থেকে নামিয়ে গাড়ীতে ওঠানোর সময় তাকে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলতে দেখা যায়।
সিক্রেট সার্ভিস মুখপাত্র অ্যান্থনি গুগলিয়েলমি বলেছেন প্রেসিডেন্ট নিরাপদ এবং ঘটনাটি সিক্রেট সার্ভিস তদন্ত করছে।
ডোনাল্ড ট্রামের প্রচার দল জানিয়েছে যে সাবেক প্রেসিডেন্ট এখন ‘ভালো আছেন’।
রিপাবলিকানদের প্রতিক্রিয়া:
রিপাবলিকান পার্টির বহু রাজনীতিক এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে টেনেসির সিনেটর মার্শা ব্ল্যাকবার্ন, কানসাস সিনেটর রজার মার্শাল, গাই রেসচেনথেলার এবং টিম বারশেট। সামাজিক মাধ্যম এক্স-এর তারা পোস্ট করেছেন –‘ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা’।
“আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করছি। আশা করছি সবাই আমার সাথে যোগ দিবে,” এক্স- এ লিখেছেন সাবেক স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি।
“ঈশ্বর প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের মঙ্গল করুন,” লিখেছেন কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি বিগস।
“দয়া করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তার পরিবার এবং সমাবেশে যোগ দেয়া সব দেশপ্রেমিকের জন্য প্রার্থনা করুন,” লিখেছেন নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত হাউজ রিপাবলিকান কনফারেন্সের চেয়ারওম্যান এলিস স্টেফানিক।
নির্বাচনি প্রচারণার ধরনটাকে বদলে দিবে
বিবিসির নর্থ আমেরিকা এডিটর সারাহ স্মিথ লিখেছেন যে, মুখে রক্ত নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন এবং সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা তাকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন- এ ছবি শুধু ইতিহাস বানায়নি, বরং এগুলোই নভেম্বরের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের হিসেব নিকেশ পাল্টে দিতে পারে।
জঘন্য এই রাজনৈতিক সহিংসতার নিঃসন্দেহে প্রভাব পড়বে নির্বাচনি প্রচারণায়।
ছবিটি দ্রুতই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন মি. ট্রাম্পের ছেলে এরিক ট্রাম্প, আর ক্যাপশন দিয়েছেন: ‘এই সেই যোদ্ধা যাকে আমেরিকার দরকার’।
ঘটনার পরপর একটি টেলিভিশনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন এ ধরনের সহিংসতার জায়গা আমেরিকায় নেই। তিনি তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং রাতে তিনি তার সাথে কথা বলবেন বলেও জানান।
বাইডেনের নির্বাচনি প্রচার দল সব ধরনের রাজনৈতিক বিবৃতি বন্ধ রেখেছে এবং দ্রুতই টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলো না দেয়ার জন্য কাজ করছেন। কারণ তাদের বিশ্বাস মি. ট্রাম্পের ওপর হামলার এই সময়ে এগুলো মানানসই হবে না। বরং যা ঘটেছে তার নিন্দা জানানোর দিকে মনোযোগ দেয়াই হবে শ্রেয়।
সব মতের রাজনীতিকরাই এক হয়ে বলছেন যে গণতন্ত্রে সহিংসতার জায়গা নেই।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন এবং জিমি কার্টার দ্রুতই এ সহিংসতার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং ট্রাম্প গুরুতর আহত হননি শুনে তারা কতটা স্বস্তি পেয়েছেন সেটি বলেছেন।
কিন্তু ট্রাম্পের কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং সমর্থকরা সহিংসতার জন্য ইতোমধ্যেই মি. বাইডেনকে দোষারোপ করা শুরু করেছেন। একজন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত করেছেন ‘হত্যাকাণ্ডের উস্কানি দেয়ার জন্য’।
সিনেটর জেডি ভান্সকে মনে করা হচ্ছে ট্রাম্পের সম্ভাব্য ভাইস প্রেসিডেন্টদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছেন। তিনি বলেছেন বাইডেনের প্রচারণাই সরাসরি এ ঘটনার দিকে নিয়ে গেছে।
একই ধরনের বক্তব্য এসেছে আরও কয়েকজন রিপাবলিকান রাজনীতিকের দিক থেকেও। ধারণা করা যায়, এর প্রতিবাদ নিশ্চিতভাবেই তাদের প্রতিপক্ষের দিক থেকে আসবে আমেরিকার রাজনীতির বিপজ্জনক এই সময়ে ঘৃতাহুতি হিসেবে।
আমরা এখনি লড়াইটা দেখতে পাচ্ছি যা সামনে আরও কুৎসিত হয়ে উঠতে পারে, যা আসলে নির্বাচনি প্রচারণার ধরনটাকেই বদলে দিবে।
আমেরিকার রাজনীতির অন্ধকার ও বিপজ্জনক অধ্যায়:
বিবিসির নর্থ আমেরিকা করেসপন্ডেন্ট অ্যান্থনি জার্চার লিখেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলা দেশটির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
আমেরিকার রাজনীতিতে সিকিউরিটি ও সেফটির যে ধারণা গত কয়েক দশক ধরে তৈরি হয়েছে সেটি নাটকীয়ভাবে বিপর্যস্ত হলো।
১৯৮১ সালে গুলিতে রোনাল্ড রিগ্যান গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কোন প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ওপর এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন কোন রাজনৈতিক সহিংসতা হয় তখন রাজনৈতিক মেরুকরণ ও ত্রুটিপূর্ণ কার্যক্রম দেখা যায়। যখন কোন অস্ত্র কোন ব্যক্তির ইচ্ছায় ব্যবহৃত হয় তখন এটি ইতিহাসের গতি প্রকৃতি পাল্টে দিতে পারে।
এই ঘটনার প্রভাব আমেরিকা এবং এর রাজনৈতিক গতি প্রকৃতির ওপর কতটা হবে তা অনুমান করা কঠিন।
কিন্তু এখন একটা বিষয় পরিষ্কার, নির্বাচনি জল গড়ানোর বছরে আমেরিকার রাজনীতি একটি নতুন কিন্তু প্রাণঘাতী মোড় নিলো।
ওয়াশিংটন করেসপন্ডেন্ট গ্যারি ওডনাহিউ পেনসিলভানিয়া থেকে লিখেছেন: এটা ছিল কিছুটা ভয়ের। মঞ্চের সামনের দিকে যারা ছিলেন তাদের মতো বিপদের মধ্যে ছিলাম না আমরা, তবে সত্যি বলতে যখন আপনাকে গুলি করতে শুরু করে তখন ভয় চলেই আসে।
আমরা আরও দেখলাম লোকজন চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে শুরু করলো এবং আমরা ভেবেছিলাম আবার কাজ শুরু করা কিছুটা নিরাপদ হবে কিন্তু লোকজন ছিলো ভীষণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ, খুবই আবেগাক্রান্ত। খুব ক্ষুব্ধ অবশ্যই।
নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে যাচ্ছে। এটা ছিলো একটা আউটডোর ভেন্যু এবং সে কারণে এর কিছু প্যারামিটার আছে—কেন নিচু ছাদ গুলোতে তাদের কেউ ছিলো না? কেন তারা সব ছাদ দেখেনি? কীভাবে একজন মানুষ একটি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে ছাদে গেলো এবং সাবেক প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে পারলো?
আমি মনে করি আমেরিকার ইতিহাসে এটা দুঃখজনক, দুঃখজনক মুহূর্ত।
ক্ষোভ ছড়িয়েছে সব জায়গায়- সমস্যা হলো কীভাবে এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এবং শুধু নির্বাচন নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও এর অর্থ কী দাঁড়াবে।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠিক করবেন কীভাবে এটি এগুবে, কীভাবে এগুলোর বাইরে গিয়ে তারা দেশকে এগিয়ে নিবেন এবং এটা সঠিকভাবে না হলে এটি খুব খারাপের দিকেও যেতে পারে।
খবর : বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
মন্তব্য