দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। স্থানীয় সময় আজ শনিবার সকাল ৭টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ভোট গ্রহণ শেষ হবে বিকেল ৪টায়। আনুষ্ঠানিক ফলাফল পাওয়া যেতে পারে রোববার সকালে।
গত বুধবার মধ্যরাতে, অর্থাৎ ভোট গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়। এ নির্বাচনে মোট প্রার্থী ৩৯ জন। তবে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণার পর এক প্রার্থী মারা যাওয়ায় বর্তমানে লড়াইয়ে আছেন ৩৮ জন। এই নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার মোট ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি ভোটার ভোট দিতে পারবেন।
২০২২ সালের ১৩ জুলাই হাজার হাজার মানুষ শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বাসভবন দখলে নিয়ে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তারপর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে গণ বিক্ষোভে বিতাড়িত রাজাপাকসে পরিবারের ফের প্রত্যাবর্তন ঘটতে চলেছে!
শ্রীলঙ্কায় কয়েক মাসব্যাপী চলা গণ বিক্ষোভ মূখে ২০২২ সালের জুলাইয়ে নাটকীয় ঘটনাবলীর মধ্যদিয়ে শ্রীলংকার রাজাপাকসে সরকারের অপমানজনক পতন হয়। সেই সময় উচ্ছ্বসিত যুবকেরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের একটি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছেন, এদের একজন নাটকীয়ভাবে নিজের গায়ে সাবান মাখছেন এবং বাকিরা উল্লাস করছে, কিংবা শ্রীলঙ্কানরা একটি বিলাসবহুল হলওয়েতে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচছেন-জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের এই চিত্রগুলোই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটা ছিল শ্রীলংকানদের কাছে বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ।
স্মরণীয় এই ঘটনার মাত্র দুই বছরের মাথায় মাহিন্দার ছেলে নামাল রাজাপাকসে আজ অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ভোটে দাড়িয়েছেন।
বহু বছর ধরে মাহিন্দার নেতৃত্বাধীন রাজাপাকসে পরিবার শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছিল। রাজাপাকসে পরিবারের এমন পরিণতি ছিল অকল্পনীয়।
শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ কারফিউ, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও জলকামান উপেক্ষা করে শান্তিপূর্ণভাবে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ অভিমুখে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় এবং গোতাবায়া রাজাপাকসেকে পদত্যাগের আহ্বান জানায়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া জনতার এ দাবি প্রত্যাখান করলেও, তার ভাই ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করে জনরোষ প্রশমনের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কয়েক মাসব্যাপী চলা এই বিক্ষোভ, সিংহলি ভাষায় যাকে বলে ‘আরাগালয় (গণবিক্ষোভ)’, ২০২২ সালের জুলাইয়ে নাটকীয় ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এর ফলে গোতাবায়া অপমানজনকভাবে পালাতে বাধ্য হন।
মাহিন্দা রাজাপাকসে তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত সমাপ্তির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই বিজয় তাকে দ্বীপরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের মধ্যে জাতীয় ‘ত্রাণকর্তা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছিল। এমনকি অতিউৎসাহী সমর্থকরা তাকে সম্রাট বলতেও কুণ্ঠিত হতেন না।
সমালোচকরা জানান, মাহিন্দা যত ক্ষমতাশালী হয়েছেন তার পরিবারের ক্ষমতাও ততই বেড়েছে। তিনি তার ছোট ভাই গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। অপর দুই ভাই বাসিল ও চামালকে যথাক্রমে অর্থমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের স্পিকারের পদে বসান।
পরিবারটি একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ-সিংহলি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর ‘চেতনা’ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়। এই চেতনায় ভর করে বছরের পর বছর ধরে তারা বিভিন্ন দুর্নীতি, অর্থনৈতিক দুঃশাসন, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমত দমনের অভিযোগ থেকে রক্ষা পেয়েছে।
তবে বেশ কয়েকটি সরকারি নীতি মুখ থুবড়ে পরায় দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের সূত্রপাত হয়। ক্রমে এর পরিণতিতে ২০২২ সালে গণবিক্ষোভের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আসে।
মাহিন্দা প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ১৭ বছর পর শ্রীলঙ্কার জনতা রাজাপাকসে পরিবারের পতন ঘটিয়েছিল। কিন্তু আসলেই কি এই পরিবারের পতন হয়েছে?
দেশটির আপামর জনতা এখনও বিশ্বাস করে-রাজাপাকসে পরিবার ফের শ্রীলংকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলে, অতীতের মতো দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী লাকশান সান্দারুয়ান গমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা খুব কষ্টের কথা যে আরাগলায় যাদের বিতাড়িত করা হয়েছিল, তারা আবার এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো কেউ কেউ আবার সেই পরিবারের সদস্যকে ভোটও দিতে পারে।’
জনমত জরিপ দেখে মনে হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে তেমন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারবে না নামাল।
উত্তরাঞ্চলীয় ভাভুনিয়ায় পুনর্বাসিত হওয়া এইচ এম সেপালিকা বিবিসি সিংহলিকে বলেন, ‘আমি কখনোই নামাল রাজাপাকসেকে ভোট দেবো না। ওই পরিবারের জন্য আমরা বছরের পর বছর ধরে যে কষ্ট সহ্য করেছি তা ভুলবার নয়।’
হাম্বানটোটার এক দোকানে কাজ করা নিশান্থি হারাপিটিয়া বলেন, ‘দেশের মানুষ একজোট হয়ে এই সংগ্রাম করেছিল, কারণ কেউ আর রাজাপাকসেকে চায়নি। কিন্তু তাদের মধ্যে এখনও এতটাই লোভ ও ক্ষমতালিপ্সা রয়েছে যে তারা ফিরে এসে জনগণকে ফের তাদের ভোট দেওয়ার কথা বলছে।’
আবার কেউ কেউ বলছেন, নামালকে এত সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।
পূর্ব শ্রীলঙ্কার কাথানকুড়ির ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হালাদিন বলেন, ‘কে তাকে ভোট দেবে?’
এবারের নির্বাচনে সবার দৃষ্টি মূলত বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা, বামপন্থী ন্যাশনাল পিপলস পার্টি জোটের অনুরা কুমারা দিসানায়েকে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিক্রমাসিংহের দিকেই নিবদ্ধ।
তবে রাজাপাকসে পরিবার এত সহজে হার মানবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে যে একসময়ের অজনপ্রিয় শক্তিশালী ব্যক্তিদের পরিবার বা মিত্ররা বিশাল সাড়ম্বরে ফের রাজনীতিতে ফিরে আসছেন। যেমন: ফিলিপাইনের বংবং মার্কোস বা এমনকি ইন্দোনেশিয়ার প্রাবোও সুবিয়ান্তো।
অধ্যাপক উয়ানগোদা বলেন, ‘নামাল রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক থাকতে চান, এসএলপিপিরভোটের চেতনা রক্ষা করতে চান এবং ২০২৯ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকতে চান।’
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাকশান সান্দারুওয়ানও এ বিষয়ে একমত।
তিনি বলেন, ‘নামাল ২০২৯ সালের পটভূমি প্রস্তুত করার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, এবার রাষ্ট্রপতি হওয়া তার লক্ষ্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু জনগণ যদি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ না করে, তাহলে জনগণ নিজেরাই আবার রাজাপাকসে পরিবারের কাউকে প্রেসিডেন্ট পদে বসাবে।’
মন্তব্য