গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত ধাঁধার চর পরিদর্শন করেছেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম। তিনি শুক্রবার বিকালে শীতলক্ষ্যা নদীর বুক চিরে জেগে ওঠা এ চরটির মনোরম ও মনোলোভা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম শুক্রবার বিকালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ধাঁধার চর আসেন। এসময় কয়েকজন অতিথি ছাড়াও গাজীপুরের অতিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: মশিউর রহমান, গাজীপুরের অতিক্তি জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মামুন সরদার, কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসা: ইসমত আরাসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
ধাঁধার চর পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, অত্যন্ত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। দেখে খুব ভালো লেগেছে। এখানে পর্যটনের জন্য কি করা যায় সেটি দেখার জন্য আসলাম। ধাঁধার চরের উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। ,
জানা যায়, চারপাশে টলটলে অথৈ জলরাশি, মাঝখানে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে সবুজ বেষ্টিত নয়নাভিরাম এক চর। শুধু চর নয়, বিশাল চর। প্রায় দুইশ একর আয়তনের এ চরের আকৃতি অনেকটা নৌকার মতো। দুই পাশ সরু হয়ে চরের শুরু, মাঝখানে পেট মোটা। দূর থেকে দেখলে এ চরটিকে অনেকটা সেন্টমার্টিনের মতো মনে হয়, কারও কারও মনে হতে পারে এ যেন ডুবে যাওয়া টাইটানিকের জেগে ওঠা। আর এ চরটির নাম ধাঁধার চর। গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার রাণীগঞ্জ এলাকায় বানার নদী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গম স্থলের পাশেই শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝখানে প্রায় দুইশো বছর আগে জেগে ওঠেছে এ চর।
বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদের নাম ব্রহ্মপুত্র নদ। বাংলাদেশকে প্রায় আড়াই প্যাঁচে আবৃত করে আছে এই নদ। গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক এলাকায় এসে এ নদটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একটি কাপাসিয়া উপজেলার পূর্বপাশ দিয়ে গাজীপুর ও নরসিংদী জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রাণীগঞ্জ এলাকায় এসেছে। অপর অংশটি কাপাসিয়া উপজেলার পশ্চিম সীমান্ত এলাকা দিয়ে দিয়ে বানারনদী নাম নিয়ে কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাপাসিয়া উপজেলার রাণীগঞ্জ এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে। এখানে বানার নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গম স্থলে এসেছে এটি শীতলক্ষ্যা নদী নাম ধারণ করেছে। পরে এখান থেকে শীতলক্ষ্যা কালীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদরের ধলেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে। পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানির জন্য শীতলক্ষ্যার খ্যাতি রয়েছে।
কাপাসিয়া উপজেলার রাণীগঞ্জ এলাকায় বানার নদী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গম স্থলের মাঝখানে প্রাকৃতিকভাবে তৈরী হয়েছে নৌকা আকৃতির এক বিশাল চর, নাম ধাঁধার চর। আনুমানিক ২০০ বছর আগে জেগে ওঠা এই চর স্থানীয়রা কেউ কেউ বলেন মাঝের চর। কারণ এটি শীতলক্ষা নদীর মাঝখানে জেগে ওঠেছে। আবার ধাঁধার চরের ভৌগলিক অবস্থানটাও বেশ ধাঁধাঁ লাগানো। চরের উত্তরে বানার নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গম স্থল, পশ্চিম ও দক্ষিণে শীতলক্ষ্যা নদী, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ। দুই দিকে দুই জেলার দুই থানা, পশ্চিমে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও পূর্বদিকে নরসিংদী জেলার শিবপুর। বর্ষা মৌসুমে দুটি নদীই থাকে খরস্রোতা, জলে টুইটম্বুর। শীতকালে এটি হয়ে ওঠে আরও মনোরম, আরও মনোলোভা। স্থানীয় রাণীগঞ্জ, তারাগঞ্জ, লাখপুর ও চরসিন্দুরের মাঝখানে এ চরকে দেখলে মনে হয় ভাসমান একটি গ্রাম। এ চরটি লম্বায় ৪ কিলোমিটার, চওড়ায় বর্ষায় আধা কিলোমিটার। শীতকালে এটি আরও বিস্তৃত হয়।
একসময় এই চরের নাম-নিশানা ছিল না। ছিল বহমান নদী। তারপর আস্তে আস্তে বিন্দু বিন্দু বালুকণা জমতে জমতে বেলেমাটিতে পূর্ণ হয়ে একসময় যখন চর জেগে ওঠে, তখন স্থানীয় লোকজন এটি দেখে ধাঁধায় পড়ে যান। সেই থেকে এর নাম ধাঁধার চর।
প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান ধাধার চর। অপরূপ ও অনাবিল এ সৌন্দর্য অবলোকন করলে মনে হয় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মনের সব দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করে দেয়। আর এই অপরূপ সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করে রাখার মজাই আলাদা। এখানে রয়েছে পেয়ারা বাগান, কলাবাগান, সারি সারি তালগাছ, জামগাছ, কুল বাগান ও নানা প্রজাতির অসংখ্য ঔষধিগাছ। স্থানীয় কৃষকগণ বিভিন্ন সবজী ও মৌসুমী ফসল চাষ করে থাকেন। রয়েছে দৃষ্টি নন্দন পেয়াজ ও সর্ষে ক্ষেত। পাশেই নদীতে থৈ থৈ জলরাশি। উপরে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা নীল আকাশ। মাছরাঙা পাখির হুটহাট জলচুম্বন, পানকৌড়ির লুকোচুরি, ঝিরঝিরে বাতাস, নানা পাখির কলকাকলি, নদীতে স্থানীয় মাঝির আকুল করা গান যে কাউকে বিমোহিত করবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দেখতে পাওয়া যায় হঠাৎ জলের স্তর ভেঙ্গে জেগে ওঠা শুশুক। জলের সাদা ফেনা বিরতি দিয়ে দিয়ে আছড়ে পড়ছে গভীর জলের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ধাঁধার চরের বুক। চরটির পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বটতলায় আছে ঐতিহাসিক ঘিঘাট। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অষ্টমী তিথিতে এ ঘাটে পুণ্যস্নান করেন।
বিকেলে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের পূর্বপ্রান্তে সূর্য মামা যখন হেলে পড়ে তখন চরের দৃশ্য বড়ই মনোরম লাগে। তখন চরের লম্বা গাছগুলো নিজের রং গোপন করে সবুজাভ রক্তিম আভা ছড়িয়ে সন্ধ্যাকে আমন্ত্রণ জানায়। যেন টকটকে লাল সূর্য শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের গভীরে রাতের জন্য ঘুমাতে যাচ্ছে। হয়তো গভীর রাতে আকাশ ভেঙে নামবে ধবল জোছনা। রাতের শেষে চরের ঘুম ভাঙ্গিয়ে নতুন সূর্য চরের গায়ে নতুন দিনের জামা পরিয়ে দেবেন। উদিত সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে ধাঁধার চর। প্রকৃতির এ অপরূপ রূপ দর্শনে শীত এবং বর্ষা মৌসুম ছাড়াও ঈদে দূরদূরান্ত থেকে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। এই চরটি যদি পর্যটন করপোরেশনের আওতায় আনা হয়, এখানে বিশ্রাম ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে পর্যটকরা এটি দেখে মুগ্ধ হবেন। আর সরকার পেতে পারে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। সত্যিকার অর্থেই এটি দেখার মতো একটি জায়গা।