গণবাণী ডট কম :
গাজীপুরে মহামারি করোনা সংক্রমণ রোধকল্পে সরকারের ঘোষিত নতুন লক ডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকালে অনুষ্ঠিত করোনা সংক্রমণ রোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটির সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ভার্চুয়ালী অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গাজীপুর জেলার ভেতর থেকে কাউকে জেলার বাইরে যেতে দেওয়া হবে না এবং জেলার বাইরে থেকে কাউকে জেলার ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। একইভাবে জেলার এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় কাউকে ঢুকতে অথবা বের হতে দেওয়া হবে না। এ লক্ষ্যে জেলা এবং উপজেলা সীমান্ত গুলিতে কঠোর চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশি নজরদারি কার্যকর করা হবে।
এদিকে, লকডাউনের প্রথম দিনের সকাল গাজীপুরে অতিবাহিত হয়েছে অনেকটাই আগের নিয়মে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার সর্বত্র ঢিলেঢালাভাবে লকডাউন এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট খোলা ছিল, অফিস আদালতের কাজকর্ম অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস এবং স্থানীয় যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। রিক্সা অটোরিক্সা ইত্যাদি চলাচল স্বাভাবিক ছিল। তবে, দুপুরের পর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশকে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনে সরকার ঘোষিত লক ডাউন বাস্তবায়নে ও করোনা সংক্রমণ রোধে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের তৎপরতা দেখা যায়নি। সকালে হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে দুর্ভোগে পড়েছেন অফিসগামী লোকজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনেকে নিজ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। সাধারণ মানুষ মানছেন না সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধি। ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা ও ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় দিয়ে কিছু কিছু দূরপাল্লার গাড়ি ও আঞ্চলিক রোডে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে কমে হয়ে যায় এসব যানবাহন চলাচল। গণপরিবহন কম হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন কর্মস্থলে যাওয়া লোকজন। অনেকে স্বাস্থ্য বিধি না মেনে মহাসড়কের পাশে জটলা করেন।এক সময়ে বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গাদাগাদি করে যানবাহনে, আবার কাউকে হেটে চলাচল করতে দেখা গেছে। গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার জয়দেবপুর বাজার সহ দোকানপাট খোলা ছিল। অনেক যাত্রী রিকশা অটোরিকশাসহ হালকা যানবাহন ব্যবহার করেছেন।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল ১১ টায় গাজীপুর জেলা করোনা প্রতিরোধ বিষয়ক কমিটির ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবাই গাজীপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব সত্যব্রত সাহা, গাজীপুর জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম, গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা: খাইরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মামুন সরদার, মহানগর পুলিশ (জিএমপি) এর উপর পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) জাকির হাসান, জেলা পুলিশের প্রতিনিধিসহ কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। সভায় সরকারের ঘোষিত রাজধানীর আশেপাশের ৭ জেলা লকডাউন বিষয়ে সরকারের পরিপত্র পর্যালোচনা করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সরকার ঘোষিত লকডাউন কঠোরভাবে জেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। এ লক্ষ্যে কতিপয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; গাজীপুর জেলার ভেতর থেকে কাউকে জেলার বাইরে যেতে দেওয়া হবে না এবং জেলার বাইরে থেকে কাউকে জেলার ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। একইভাবে জেলার এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় কাউকে ঢুকতে অথবা বের হতে দেওয়া হবে না। এ লক্ষ্যে জেলা এবং উপজেলা সীমান্ত গুলিতে কঠোর চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশি নজরদারি কার্যকর করা হবে। গাজীপুর মহানগর এলাকায় গাজীপুর মহানগর পুলিশ এবং অন্যান্য এলাকায় গাজীপুর জেলা পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে উল্লেখিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। সভায় আরো সিদ্ধান্ত হয়, জেলায় সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শুধুমাত্র কাঁচা বাজার খোলা থাকবে আর অন্য সকল দোকানপাট বন্ধ থাকবে। তবে ঔষধের দোকান ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা যাবে। এছাড়া জরুরী সেবা আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে।
সভায় আরো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, জেলার অভ্যন্তরে সকল প্রকার গণপরিবহন, ব্যক্তিগত যানবাহন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। রিকশা-অটোরিকশা টেম্পু ইত্যাদি চলাচল বন্ধ রাখা হবে। জরুরী প্রয়োজন ও যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোন লোক রাস্তায় চলাচল করতে পারবে না।
আরো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, গাজীপুর একটি শিল্প অধ্যুষিত এলাকা। এখানে প্রায় দুই সহস্রাধিক রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প কলকারখানা রয়েছে। এসব শিল্প-কলকারখানা খোলা থাকবে। তবে কারখানার বাইরে অবস্থানকারী শ্রমিকদের কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব যানবাহনের মাধ্যমে কারখানায় আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এসব কারখানার ম্যানেজমেন্ট এর সাথে জড়িত কোন ব্যক্তি কারখানার বাইরে থাকতে পারবেন না, তাদেরকে কারখানার ভিতরে অবস্থান করতে হবে। জেলার বাইরে থেকে কোন ব্যক্তিকেই এমনকি এ সমস্ত কারখানার সাথে জড়িত কাউকেই জেলার বাইরে থেকে জেলায় প্রবেশ করতে অথবা বাইরে যেতে দেওয়া হবে না।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মামুন সরদার জানান, প্রথম দিন সকাল থেকে কিছুটা শিথিলতা থাকলেও করোনা বিষয়ক কমিটির সভার পর থেকে আমরা কঠোরভাবে জেলায় লক ডাউন বাস্তবায়ন শুরু করেছি। গৃহীত সকল সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তাবায়ন করা হবে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও মিডিয়া) জাকির হাসান জানান, করোনা বিষয়ক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আমদের মহানগর এলাকায় বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। একইভাবে কাউকে বাইরে যেতে দিচ্ছি না। আমাদের মহানগরের সকল প্রবেশ পথে চেকপোস্ট বসিয়ে কড়া নজরদারী চালানো হচ্ছে। তিনি আরো জানান, লকডাউন বাস্তবায়নে তারা মাঠে রয়েছেন। মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি, জনসমাগম এলাকায় ৭টি চেকপোস্ট ও কয়েকটি মোবাইল টিম কাজ করছে। বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতামূলক মাইকিং করা হচ্ছে। দোকান পাট বন্ধ রাখার জন্য পুলিশ তৎপর রয়েছে।
তিনি আরো জানান, জেলার অভ্যন্তরে সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) লকডাউন বাস্তবায়নে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মানুষকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নিজ নিজ এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন এছাড়া গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একই লক্ষ্য নিয়ে মহানগরসহ বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। এ সময় লকডাউন ও সরকারের স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে যাঁরা ঘরের বাইরে আসবেন, তাদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ বিভিন্ন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসন তৎপর থাকবে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে জেলা প্রশাসক জেলাবাসীকে লকডাউন চলাকালীন সময়ে ঘরে অবস্থান করে সরকারি নির্দেশনা মেনে লকডাউন কার্যকর করার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ রোধকল্পে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানান।
এদিকে গাজীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘন্টায় গাজীপুর জেলায় ৩১০ জন্য নমুনা পরীক্ষা করে ৫৬ জনের মধ্যে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৬ জন, কাপাসিয়ায় ৬ জন, শ্রীপুরে ১৪ জন এবং গাজীপুর সদর (মহানগরীসহ) ৩০ জন করোনা সংক্রমিত হয়েছেন।
অপরদিকে জেলায় এ পর্যন্ত ২২৭ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন আর সুস্থ হয়েছেন ১০ হাজার ৫৯৬ জন।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে আরো জানা গেছে জেলায় এ পর্যন্ত ৮৭ হাজার ৯৭৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মোট করোনা শনাক্ত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৬ জন। করোনা সংক্রমিত লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে গাজীপুর সদরে (মহানগরীসহ)। এখানে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ৮৮৩ জন। জেলার অন্যান্য উপজেলার মধ্যে কালিয়াকৈরে ১হাজার ২২২ জন, শ্রীপুরে ১ হাজার ৩০৮ জন, কালীগঞ্জে ৮৬৩ জন, কাপাসিয়ায় ৭৬০ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।