গণবাণী ডট কম:
মহামারি করোনা সংক্রমণ রোধ কল্পে ঘোষিত লকডাউনের কারণে ঘরে থেকে কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায় পরিবারকে গত ১৫ মাস ধরে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। খাদ্য সহায়তা গ্রহণ করার জন্য যাতে কাউকে লকডাউন ভেঙ্গে ঘরের বাইরে আসতে না হয় এবং অনেকে সামাজিকতার কারণে প্রকাশ্যে এসে খাদ্য সহায়তা নিতে পারছেন না, সে কারণে মানুষদের ঘরে ঘরে রাতে আধারে ও গোপনে খাদ্য সহায়তা পৌছে দেয়া হচ্ছে। মহতী এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম। তার সাথে রয়েছেন একদল উদ্যোমী যুবক, যারা সারারাত নির্ঘুম থেকে মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্য সহায়তা পৌছে দিচ্ছেন।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি সহায়তার বাইরে, জেলা প্রশাসকের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এবং অর্থায়নে করোনা মহামারীর শুরুর পর প্রথম দফার সাধারণ ছুটি চলাকালীন সময়ে প্রায় ৩৯ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। বর্তমানে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ তথা লকডাউনের সময়ে এ পর্যন্ত আরো ১৫ হাজার পরিবারের নিকট খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫শ থেকে ৬শ পরিবারের নিকট খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মামুন সরদার জানান, সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্ধকৃত খাদ্য সহায়তা এবং জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলামের নিজস্ব উদ্যোগে ও বিত্তবানদের অর্থায়নে, তাঁর নির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় পরিবহন শ্রমিক, দর্জি, চটপটি দোকানের কর্মচারী, হকার, চা ও পিঠা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, রাজ যোগালি, দিন মজুর এবং দুস্থ পরিবারের যারা লকডাউনের সময় কর্মহীন হয়ে কষ্টে আছেন। তাদের খাদ্য সংকট দুর করার জন্য কোভিড ১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় গাজীপুর জেলায় মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এসব খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করার পর এস এম তরিকুল ইসলাম তার সততা আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠা দিয়ে অনেক আগেই জেলাবাসীর মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। সম্প্রতি তাকে ২০২০ সালের জনপ্রশাসন পদক প্রদান করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পর তার বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোন নেতিবাচক অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। হৃদয়বান, পরোপকারী ও ভালো মানুষ হিসেবে জেলায় তার সুনাম অর্জন করেছেন।
গাজীপুর জেলা প্রশাসনের জেলা প্রশাসকের পক্ষে এ কার্যক্রম তদারক করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থান্ডার কামরুজ্জামান। তিনি জানান, করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, চাকরির বাজারে মন্দা ইত্যাদি নানা কারণে হতাশায় যুব সমাজের অনেকেই যখন নানাভাবে বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তখন গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একদল যুবক যারা লকডাউনের সময় ঘরে বসে মুভি দেখে, মোবাইলে চ্যাট করে বা গেম খেলে সময় নষ্ট না করে মানব সেবার মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় ১৫ মাস যাবত মানুষের সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্বেচ্ছাসেবীদের এই দলটি এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার দরিদ্র, অসহায়, কর্মহীন হয়ে খাদ্য সংকটে থাকা পরিবারের নিকট রাতের আধারে, গোপনে খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে সহায়তা করছেন গাজীপুর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ২০ জন, গাজীপুর প্যাসেঞ্জার ফোরাম এবং স্পেশাল রেসপন্স টিমের ২৭ জনসহ মোট ৪৭ জনের একদল উদ্যোমী যুবক। যাদের কেউ চাকরী করেন, কেউ ছাত্র, কেউবা বেকার।
তিনি আরো জানান, খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ১০ কেজি চাউল, ৫ কেজি আটা, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি তেল।
একাজের বিষয়টি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, গাজীপুর অফিসার্স ক্লাবে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এখানে কয়েকজন খাদ্য সামগ্রী ওজন করে প্যাকেট করছেন, কয়েকজন এসব বস্তায় ভরে বেধে দিচ্ছেন। কেউ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত নামের তালিক এলাকা বা ওয়ার্ড ভিত্তিক আলাদা করে লিপিবদ্ধ করছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাঁচটি লেগুনা ভর্তি করে ৫টি দল এসব খাদ্য সামগ্রী নিয়ে তালিকা অনুযায়ী ঠিকানায় গিয়ে ফোন করে খাদ্য সহায়তা চাওয়া ব্যক্তির ঘরে পৌছে দিয়ে থাকেন।
গাজীপুর প্যাসেঞ্জার ফোরামের সদস্য তামিম বলেন, গাজীপুর অফিসার্স ক্লাবে আমরা সকলে প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে উপস্থিত হয়ে যাই। ততক্ষণে আমাদের প্রতিদিনের লক্ষ্য নির্ধারণ হয় এবং সে অনুযায়ী আমরা খাদ্য সামগ্রী প্যাকেট করি। পরবর্তীতে এসব খাদ্যসামগ্রী আলাদা আলাদা দলের সদস্য গণ প্রতিরাতে পাঁচটি লেগুনাযোগে সংশ্লিষ্ট খাদ্যসহায়তা প্রার্থীর বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। তিনি বলেন, সরকারের ৩৩৩, জেলা প্রশাসকের হটলাইন, জেলা প্রশাসকের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত মোবাইলে ইত্যাদিতে প্রাপ্ত তথ্য তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা প্রস্তুত করি। অনেকে সরাসরি এসে নিজেদের খাদ্য সংকটের কথায় জানায়। আমরা তাদেরকে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাড়ি বাড়ি ছাদে সামগ্রী পৌঁছে দেই।
স্পেশাল রেসপন্স টিমের সদস্য মাসুম বলেন, প্রতিদিন বিকাল ৫টা খেকে প্যাকেট করা, তালিকা করা শুরু হয় এবং সন্ধ্যা ৬ টা থেকে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এই কার্যক্রম শুরু হয়। তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেক খাদ্য সংকটে থাকা পরিবারের নিকট এসব খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার পর দিনের কার্যক্রম শেষ হয়। একাজে অনেক সময় স্বেচ্ছাসেবীদের রাত পার হয়ে ভোর পর্যন্ত এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ছুটতে হয়।
রেড ক্রিসেন্ট এর সদস্য আলামিন বলেন, করোনা মহামারীকালে মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য এই মহতী কাজ করতে পেরে এর সাথে জড়িত সকলের খুবই সন্তুষ্ট। মানুষের সেবা করতে পারার এই সুযোগ পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত। রাত জেগে কাজ করার বিষয়টি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এখন আর আমাদের রাত জাগার কারণে কোনো ক্লান্তি বোধ হয় না।
জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনুশাসন রয়েছে, করোনার সংকটের সময়ে কোনো মানুষ যেন খাদ্য সংকটে না থাকে, খাদ্যের কষ্টে যেন না পড়ে, সেই কারণে এই অনুশাসন কে সামনে রেখে গাজীপুর জেলায় আমরা এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেছি। আমাদের লক্ষ্য কোন মানুষ যাতে খাদ্য সংকটের কারণে ক্ষুধার্থ না থাকে, কেউ যেন খাদ্যের কষ্টে না পড়েন, তার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা। যতদিন মানুষের নিকট থেকে চাহিদা পাওয়া যাবে, ততদিন এই মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে।