গণবাণী ডট কম:
স্ত্রীকে স্বাসরোধে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য মৃতদেহের গলায় ওড়না পেচিয়ে ঘরের আড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখে পাষন্ড স্বামী। চতুর স্বামীর চালাকিতে এটি প্রথমে আত্মহত্যা বলে প্রকাশ পাওয়ায় স্বামীর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনার প্রায় ২১ মাস পর আলোচিত গৃহবধু হত্যার রহস্য উদঘাটন করলো গাজীপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই।
পিবিআই এঘটনায় জড়িত মুল আসামীকে গ্রেফতারও করেছে। গ্রেফতারের পর আসামী গত রোববার সন্ধ্যায় গাজীপুর আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিতে ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করেছে।
নিহত গৃহবধূর নাম বৃষ্টি খাতুন (২৪)। তিনি কুস্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার চরভবনন্দদীয়া গ্রামের সিদ্দিকুর রহমানের মেয়ে।
গ্রেফতার স্বামীর নাম মোঃ সোহেল রানা (২৭)। তিনি দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানার শিবপুর গ্রামের মোঃ কোহিনুর প্রমানিকের ছেলে। তিনি গাজীপুর সদর উপজেলাধীন ভবানীপুরে জনৈক মোঃ মিজানুর রহমান মজনু মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া। তাকে গত ১৪ মে বেলা পৌনে ১২টার দিকে নবাবগঞ্জ থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গাজীপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান সোমবার দুপুরে এসব তথ্য জানান।
তিনি আরো জানান, প্রায় ৫ বছর প্রেম করার পর গত ২০১২ সালে সোহেল রানার সাথে বৃষ্টি খাতুনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা গাজীপুর সদর উপজেলার জয়দেবপুর থানাধীন ভবানীপুর সাকিনে মোঃ মিজানুর রহমান মজনু মিয়ার বাড়ির ভাড়া থেকে স্বামী-স্ত্রী গার্মেন্সে চাকুরি করতো। তাদের একটি ১ টি ছেলে রয়েছে। ২০২০ সালের ৭ আগস্ট সকালে নিজ ঘরের আড়ার সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় বৃষ্টির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনা বৃষ্টির পিতা বাদী হয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে জয়দেবপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, বিয়ের পর তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকলেও পরে সোহেল রানা তার বাবা মায়ের প্ররোচনায়, সহায়তায় ও ইন্ধনে বৃষ্টিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার নির্যাতন করতঃ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো এবং কারনে অকারনে আত্মহত্যা করার জন্য প্ররোচিত করতো। এ কারণে গত ০৭/০৮/২০২০ তারিখ বেলা অনুমান ১১ টা হতে ১২টার মধ্যে যে কোন সময় জয়দেবপুর থানাধীন ভবানীপুর দক্ষিণ নয়াপাড়া সাকিনস্থ জনৈক মোঃ মিজানুর রহমান মজনু মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া বাড়িতে ১নং বিবাদী মোঃ সোহেল রানার ভাড়াকৃত টিনসেট বিশিষ্ট চৌচালা বসত ঘরের বারান্দার ঘরের আড়ার সাথে উড়না দ্বারা গলায় ফাঁস লাগাইয়া আত্মহত্যা করে। উক্ত বিবাদী তার স্ত্রী জীবিত আছে ধারনা করিয়া বৃষ্টি খাতুনকে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বৃষ্টিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মৃত ঘোষনা করে। ময়মনসিংহ কোতয়ালী থানার অফিসার বৃষ্টির সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত পূর্বক ময়না তদন্তের জন্য লাশ ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে। এই সংবাদ পাইয়া ডিসিষ্টের বাবা পরিবারসহ উক্ত হাসপাতালে এসে বৃষ্টির লাশ সনাক্ত করে। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে জয়দেবপুর থানার মামলা (নং-০৭) ধারা-৩০৬/১০৯ পেনাল কোড রুজু হয়। পরবর্তীতে ময়না তদন্তের রিপোর্টের প্রেক্ষিতে হত্যা মামলায় রুপান্তরিত হয়। অর্থাৎ ৩০৬/১০৯ তৎসহ ৩০২ পেনাল কোড যুক্ত হয়।
তিনি আরো জানান, মামলাটি জয়দেবপুর থানা পুলিশ প্রায় ৪ মাস তদন্ত করে কোন আসামী গ্রেফতার না করে বিঞ্জ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই গাজীপুরকে নির্দেশ প্রদান করেন। পরে পিবিআই এর অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদারের সঠিক তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় পিবিআই এর গাজীপুর ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমানের সার্বিক সহযোগীতায় মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) মোঃ মনিরুজ্জামান মামলাটি তদন্ত করেন।
তিনি আরো জানান, তদন্তকালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৪ মে বেলা পৌনে ১২টার দিকে সোহেল রানাকে নবাবগঞ্জ থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, আসামী মোঃ সোহেল রানার সাথে তার স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক করে ২০১২ সালে বিবাহ করে এবং বিবাহের ০১ বছর পরেই জয়দেবপুর থানাধীন ভবানীপুর সাকিনে মোঃ মিজানুর রহমান মজনু মিয়ার বাড়ির ভাড়া থাকিয়া স্বামী-স্ত্রী গার্মেন্সে চাকুরি করিত এবং তাদের ফাহিম প্রমানিক (০৪) নামে একজন পুত্র সন্তান আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন সময় ঝগড়া বিবাদ হত। ঘটনার ০৬ দিন আগে ঈদের ছুটিতে আসামী মোঃ সোহেল ও তার স্ত্রী সন্তানসহ শ্বশুর বাড়িতে ঈদ করতে যায়। ঈদ শেষে একমাত্র সন্তানকে শ্বশুর বাড়ীতে রেখে স্বামী-স্ত্রী দুইজন কর্মস্থলে চলে আসে। ঘটনার দিন অর্থাৎ ০৭/০৮/২০২০ তারিখ রাত্র অনুমান ০২.১৫ ঘটিকার সময় আসামী ও তার স্ত্রী ঘুমাতে যায় এবং সকাল ০৯.০০ ঘটিকার সময় স্বামী-স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে। পরবর্তীতে অনুমান সকাল ১০.০০ ঘটিকার দিকে আসামীর সাথে তার স্ত্রীর কাপড় ধোয়া নিয়ে কথা কাটা কাটি হয় এবং দুইজনের সাথে দস্তাদস্তি শুরু হয়। এরপর ভিকটিম উচ্চস্বরে চিৎকার শুরু করিলে আসামী সোহেল রানা তার স্ত্রী এর গলা চেপে ধরে রাখে। কিছু সময় পরে ভিকটিম এর শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আসামী সোহেল রানা বিষয়টিকে আত্মহত্যায় রুপান্তরিত করার জন্য ডিসিষ্ট এর গলায় ওড়না বেধে বারান্দার আড়ার সাথে টানিয়ে রাখে। এরপর আসামী সু-কৌশলে বারান্দা ও বেড রুমের দরজা বন্ধ করে ঘরের চালের সিলিং এর ফাঁকা দিয়ে বেড রুমে গিয়ে চিৎকার শুরু করে। এরপর আসামী সোহেল রানা আশে পাশের লোকজনকে ডাকা ডাকি করে বলেন যে, তার স্ত্রী দরজা বন্ধ করে রেখেছে দরজা খুলছে না। আশেপাশের লোকজন আসার পর আসামী ঘরের সিলিং ফাঁকা করে বেড রুমে থেকে বারান্দার রুমে এসে দরজা খুলে। খোলার পর সবাই মিলে দেখতে পায় তার স্ত্রী ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। পরবর্তীতে আশে পাশের লোকজনের সহায়তায় তার স্ত্রীকে ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে নামিয়ে জয়দেবপুর থানাধীন মনিপুর পপুলার হাসপাতালে নেয়। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডিসিষ্টকে মৃত ঘোষনা করে।
এ বিষয়ে পিবিআই এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, এটি একটি হত্যা মামলা। মামলার গ্রেফতারকৃত আসামী নিজেই ভিকটিমকে গলা টিপে হত্যা করে। পরবর্তীতে উক্ত হত্যার ঘটনাটিকে আত্মহত্যায় রুপান্তরিত করার জন্য ভিকটিমের নিজ ওড়না দিয়ে বারান্দার আড়ার সাথে টানিয়ে রাখে। উক্ত আসামীকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করার পর বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। এর ফলে মামলার মূল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়।