গণবাণী ডট কম:
মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ, দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি কামনা করে আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাবলিগ জামাতের শুরায়ে নিজামের উদ্যোগে আয়োজিত এবারের ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। মোনাজাত পরিচালনা করেন তাবলিগ জামাতের বাংলাদেশের শীর্ষ মুরুব্বি, কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব মাওলানা জুবায়ের আহমেদ। আখেরী মোনাজাতের পরেই তাবলীগের নতুন নতুন জামাত দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে।
আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ সবকিছু বন্ধ রাখা হয়।
রোববার সকাল ৯টা ১ মিনিটে শুরু হয়ে মোনাজাত শেষ হয় সকাল ৯টা ২৩ মিনিটে। ইজতেমা ময়দানের ভিতরে বিদেশি মুসুল্লীদের খিত্তার পাশের বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকে মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। দেশ বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি মোনাজাতে শরিক হন। মোনাজাত চলাকালীন পিন পতন নীরবতার মধ্যে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরের ইজতেমা ময়দান ও ময়দানের আশপাশ এলাকা থেমে থেমে মানুষের কান্না ও আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
ইজতেমা আয়োজকদের মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, আখেরী মোনাজাতের আগে ফজরের নামাজের পর হেদায়েতী বয়ানের মাধ্যমে শুরু হয় তৃতীয় দিন বা শেষ দিনের কার্যক্রম। যারা নতুন জামাত বন্দি হয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হবেন তাবলীগের সফরে, তাদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনা মূলক হেদায়েতী বয়ান করা হয়। হেদায়েতী বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। হেদায়েতী বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। তারপরে মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে এবারেই প্রথম নসীয়ত মূলক কিছু কথা বলেছেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। তার কথা বাংলায় তরজমা করেছেন মাওলানা জুবায়ের। তিনি তরজমা শেষ করেই মোনাজাত আরম্ভ করেন।
আখেরী মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সকল মুসলিমের ইহকাল ও পরকালের নাজাত কামনা করা হয়। নিজের আত্মশুদ্ধি ও সব ধরণের গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য পরম দয়ালু মহান আল্লাহ কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে দুনিয়াবি বালা মুসিবত থেকে পরিত্রাণের জন্য আকুতি-মিনতি জানানো হয়। এসময় মুসুল্লীরা দু-হাত তুলে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনা করেন। তারা কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, দ্বীনের রাস্তায় চলার জন্য হেদায়েত কামনা করেন, পারলৌকিক সুখ ও শান্তি, আল্লাহর সন্তোষ্টি লাভের জন্য আহাজারি করেন। এসময় রোগ থেকে আরোগ্য লাভ, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া ব্যাক্তিদের রোহের মাগফিরাত কামনা করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করা লাখ লাখ মুসুল্লী ছাড়াও মোনজাতে অংশ নিয়েছেন ঢাকা ও গাজীপুরের চারপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত লাখ লাখ মুসুল্লী। এক দিন আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল, মোনাজাত হবে রোববার সকাল ৯ টা থেকে ১০টার মধ্যে। ফলে মোনাজাত উপলক্ষে শনিবার রাতের মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় পুরো ইজতেমা ময়দান। ময়দানে জায়গা না পেয়ে রাতভর ও সকালে লাখ লাখ মুসুল্লী অবস্থান করেন মহাসড়ক ও আশপাশের গলিতে। একারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের ভোগড়া এবং আশেপাশের মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। একারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ মুসুল্লী বাস, ট্রাক, কার, মাইক্রোবাস, ট্রেন, লঞ্চে করে রোববার সকালে টঙ্গীতে আসেন আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে। আব্দুল্লাহপুর থেকে ভোগড়া বাইপাস এই ১২ কিলোমিটরা পথ হেঁটে অনেকে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিয়ে ইজতেমার ময়দানের কাছাকাছি পৌঁছান। ভীড়ের কারণে লাখ মুসুল্লী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কামারপাড়া সড়ক, বিভিন্ন গলিপথ, বাসা বাড়ীর ছাদসহ যে যেখানে পেরেছেন দাড়িয়ে ও বসে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
আখেরী মোনাজাত বিভিন্ন টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসিরি সম্প্রচার হওয়ায় এবং অনেকে মোবাইল ফোনের সুবাদে দেশে বিদেশে দুর দুরান্ত এলাকায় থেকেও মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে রোববার সকালে এসেছেন আমিনুর রহমান। তিনি জানান, ভোর ৪টায় সিএনজি নিয়ে রওনা হয়ে জয়দেবপুর। সেখান থেকে অটো নিয়ে ভোগড়া বাইপাসে আসার পর কোন যানবাহন না পেয়ে হাজারো মুসুল্লীর সাথে পায়ে হেটে ময়দানের কাছে এসেছেন। তিনি বলেন, মোনাজাতে অংশ নিতে পেরেছি, এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
আখেরী মোনাজাতে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ:
আখেরী মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো: জাহিদ আহসান রাসেল, পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের গণশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকী চৌধুরী, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এড. আজমত উল্লা খান, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবুল আলম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এড. মো: জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।
মোনাজাতে নারীদের অংশগ্রহণ :
ইজতেমা ময়দানে মহিলাদের জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় ময়দানের বাইরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে অনেক মহিলাকেও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা গেছে। কয়েক হাজার মহিলা ইজতেমা ময়দানের আশপাশ, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন দালানের ছাঁদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। তারা মোনাজাতের ফজিলত লাভের আশায় পর্দা বঝায় রেখে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
প্রথম পর্বে মোট ১৯ মুসল্লীর মৃত্যু :
এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বে মোট ১৯ জন মুসুল্লী মৃত্যুবরণ করেছেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী মো. হাবিবুল্লাহ রায়হান। তিনি জানান, মৃতদের মধ্যে ময়দানে মারা গেছেন ১৩ জন এবং ময়দানের বাইরে ইজতেমায় আসার পথে মারা গেছেন ৬ জন। সকলের জানাজার নামাজ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাদের স্বজনেরা মরদেহ নিজ নিজ গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যায়।
ফিরতি পথে ভোগান্তি:
রোববার সকাল সাড়ে ৯টার কিছু আগে আখেরী মোনাজাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় ফিরতি যাত্রা। যে সকল মুসুল্লী রোববার সকালে মোনাজাতে অংশ নিতে এসেছিলেন, তারা পুনরায় বাস, ট্রাক, কার, মাইক্রোবাস, রিক্সা, অটোরিক্সা, ভ্যানগাড়ী ও ট্রেনে চড়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ময়দান ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়া মুসুল্লীদের মধ্যে যারা জামাত বন্দি হননি এমন মুসুল্লীরাও এসময় ফিরতি যাত্রা করেন। একারণে ময়দানের চারপাশের সকল সড়ক ও মহাসড়কে মানুষের চাপ বেড়ে যায়। এসময় মানুষের স্রোত পিল পিল করে ময়দান থেকে বিভিন্ন পথের দিকে ধাবিত হতে থাকে। হাজার হাজার মানুষ কোন যান বাহন না পেয়ে পায়ে হেটে গন্তব্যের দিকে যাত্রা করেন। এসময় ভীড় ও যানজটের কারণে সবাইকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রীর তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় অনেক যানবাহনে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। কাধে সামানার বুঝা নিয়ে দীর্ঘ পথ হেটে যাওয়ার চেয়ে বাধ্য হয়ে বেশী ভাড়ায় গন্তব্যে রওয়ানা হয়েছেন অনেক যাত্রী।
মোনাজাতে অংশ নিতে আসার পথে নিহত দুই:
রোববার সকালে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে আাসার পথে গাজীপুরের টঙ্গীতে দুইজন নিহত এবং পথচারীসহ ১১ জন আহত হয়েছেন। রোববার সকালে টঙ্গী-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের শিলমুন এলাকায় কাভার্ড ভ্যান ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে এ হতাহতের দুর্ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় নিহতরা হলো, অটোরিকশার আরোহী জনি (১৮) ও সোহেল (৪০)। তারা নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার দক্ষিণ সাধারচর গ্রামের মনির হোসেনের ছেলে জনি এবং একই গ্রামের কাজল মিয়ার ছেলে সোহেল।
আহতরা হলেন, ফিরোজ (৫০), জহিরুল ইসলাম (৫২), জিসান (২২), জাহিদ হাসান (৩৫), ইকবাল হোসেন (৫৫), নজরুল ইসলাম (৫০), আনিসুর রহমান ৪২), বোরহান উদ্দিন (৫০) ও বাছির উদ্দিন (৫৫)।
টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রোববার সকাল পৌনে ৭টার দিকে অটোরিকশাযোগে হতাহতরা ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ময়দানের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ২ জন নিহত ও অন্তত ১১ জন আহত হন।
ওসি আরও বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই দুজনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ কাভার্ড ভ্যানটি জব্দ করেছে।
উল্লেখ্য, তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বী ভারতের দিল্লি মারকাজের মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর কিছু কথার প্রেক্ষিতে তাবলীগের মুরুব্বীদের মধ্যে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়। তাদের একটি গ্রুপ ভারতের মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর অনুসারী অপরটি বাংলাদেশের মাওলারা যোবায়ের অনুসারী হিসাবে এতদিন পরিচিত থাকলে এবারের ইজতেমায় যোবায়ের অনুসারীগণ নিজেদের শুরায়ে নিজাম হিসাবে পরিচয় দিচ্ছেন। একারণে এবারও বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে দুই পর্বে। শুরায়ে নিজামের আয়োজনে ইজতেমার প্রথম পর্বে গত শুক্রবার শুরু হয়ে রোববার শেষ হলো।
আর সা’দ কান্ধলভীর অনুসারীদের ইজতেমা আগামী শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) শুরু হবে। সেই পর্ব আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।