গণবাণী ডট কম:
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি ধান উৎপাদনকে লাভজনক করার মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধির উপায় উদ্ভাবনের জন্য ব্রির বিজ্ঞানীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর ২০১৯) গাজীপুরে ব্রির বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা ২০১৮-১৯ এর উদ্বোধনী সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। কর্মশালায় মন্ত্রী আরো বলেন, ব্রির বিজ্ঞানীদের কল্যাণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এমনকি চাল উৎপাদনে উদ্বৃত্ব অবস্থানে চলে এসেছে। এখন নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, আর সেটি হলো ধান উৎপাদন তথা সার্বিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে কৃষকের জন্য লাভজনক করা।
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কমলারঞ্জন দাশ এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর ড. এম এ সাত্তার মÐল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. মো. কবির ইকরামুল হক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. আবদুল মুঈদ। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। ব্রির পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) ড. কৃষ্ণ পদ হালদার এতে ধন্যবাদ সূচক বক্তব্য রাখেন। কর্মশালায় ‘গবেষণা অগ্রগতি ২০১৮-১৯’ বিষয়ক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্রির পরিচালক (গবেষণা) ড. তমাল লতা আদিত্য।
ব্রি, বারি, বিএআরসি, ডিএই, ইরিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরবর্তী ছয় দিন ধরে চলবে কর্মশালার বিভিন্ন কারিগরী অধিবেশন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিগত এক বছরে ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজের অর্জন ও অগ্রগতির বি¯Íারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালার কারিগরী অধিবেশনগুলোতে গত এক বছরে ব্রির ১৯টি গবেষণা বিভাগ ও নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা ফলাফল সংশিøষ্ট বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলে ধরা হবে। চলতি বছর ব্রি ছয়টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে এবং এর মাধ্যমে ব্রি উদ্ভাবিত মোট ধান জাতের সংখ্যা হলো ১০০টি। চলতি বছর ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ধানের জাতগুলো হলো, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯১, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪ ও ব্রি ধান৯৫। এর মধ্যে পাঁচটি রোপা আমনের জাত এবং একটি বোরো মওসুমের জাত রয়েছে। এ জাতগুলোর গড় ফলন প্রতি হেক্টরে পাঁচ থেকে সাড়ে আট টন।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল আমন ধানের জাত ব্রি ধান৭৯, জেসমিন সদৃশ সুগন্ধি আমন ধানের জাত ব্রি ধান৮০, অনুকূল পরিবেশের উপযোগী স্থানীয় জনপ্রিয় জিরাশাইল জাতের অনুরূপ বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮১, নেরিকা ১০ এর বিশুদ্ধ সারি থেকে উদ্ভাবিত রোপা আউশ ধানের স¦ল্প মেয়াদি জাত ব্রি ধান৮২, স্থানীয় জনপ্রিয় কটকতারা জাতের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বোনা আউশ জাত ব্রি ধান৮৩, যা চারা অবস্থায় মধ্যম মাত্রায় খরা সহনশীল। এছাড়া আছে উচ্চমাত্রার জিংক (২৭.৬ পিপিএম) সমৃদ্ধ বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮৪, বৃহত্তর কুমিলøা অঞ্চলের উপযোগী রোপা আউশ ধানের জাত ব্রি ধান৮৫,অ্যানথার কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮৬। অধিকন্তু গত বছর ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে দু’টি হাইব্রিড ধানের জাত-ব্রি হাইব্রিড ধান৫ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৬।
ব্রি পূর্ববর্তী গত ১০ বছরে ৫০টি উফশী ধানের জাতসহ বেশ কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে। উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা সহনশীল বোরো জাত ব্রি ধান৬১ ও ব্রি ধান৬৭, জিঙ্ক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২ ও ব্রি ধান৭৪, ঐতিহ্যবাহী বালাম চালের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এবং সরু বালাম নামে পরিচিত জাত ব্রি ধান৬৩, সরাসরি বপনযোগ্য আগাম আউশ ধানের জাত ব্রি ধান৬৫, খরা সহনশীল ও উচ্চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ বোরো জাত ব্রি ধান৬৬, বোরো মৌসুমের আদর্শ উফশী জাত ব্রি ধান৬৮ এবং কম খরচে আবাদযোগ্য উফশী জাত ব্রি ধান৬৯।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে, দেশে কৃষক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ ফলন দিতে সক্ষম ব্রি ধান ২৯ এর সমপর্যায়ের গুণাগুণ সম্পন্ন ব্রি ধান৫৮ এবং আমন মৌসুমের জনপ্রিয় বিআর১১ এর সমতুল্য ব্রি ধান৪৯। তবে এটি ব্রি ধান২৯ এর চেয়ে প্রায় এক সপ্তাহ আগাম। পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিক‚লতা মোকাবিলার লক্ষ্যে ব্রি বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত নয়টি লবণ-সহিষ্ণু, দু’টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, তিনটি খরা সহিষ্ণু, একটি খরা পরিহারকারী, দু’টি শীত সহনশীল এবং চারটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিভিন্ন ধরনের বৈরী পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপযোগী আরো ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ দ্রæত এগিয়ে চলছে। ধানের গুণাগুণ বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন এ এবং আয়রন সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ব্রি উদ্ভাবিত সরু ও সুগন্ধযুক্ত বোরো মৌসুমের জাত ব্রি ধান৫০ বা বাংলামতি রফতানি সম্ভাবনাময়। বর্তমানে দেশের ৮০ ভাগ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের চাষাবাদ হয় এবং এর থেকে আসে দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতকরা ৯১ ভাগ।
ব্রি এ পর্যন্ত ছয়টি হাইব্রিডসহ মোট ১০০টি উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে বেশ ক’টি প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল এবং উন্নত পুষ্টি গুণ সম্পন্ন। আশা করা যাচ্ছে, এগুলো কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় হবে এবং সামগ্রিকভাবে ধান উৎপাদন বাড়বে।