গণবাণী ডট কম:
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও গাজীপুরে বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার সামর্থের সীমাবদ্ধতার মধ্যে করোনার ঊর্ধ্বগতির সংক্রমণ ভাবিয়ে তুলেছে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। আর জেলা পর্যায়ের এই কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেও স্পর্শ করেছে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তা লাঘবের জন্য গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল গাজীপুরের করোনা পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তার সাথে আরও আসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক, পুষ্টি প্রকল্পের পরিচালক, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পরিচালক। এই প্রতিনিধিদল গাজীপুরের সার্কিট হাউসে আলোচনায় মিলিত হন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডাক্তার খায়রুজ্জামান গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার মোঃ হাফিজুল এর সাথে। আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার জাকির হাসানসহ অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাগণ। তারা গাজীপুরে করোনা চিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা ও সংকটগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রতিনিধিদল ঢাকায় ফেরার আগে আলোচনায় উঠে আসা সমস্যা গুলো সামর্থ্য অনুযায়ী দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়ে গেছেন।
মহামারি করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে কঠোর বিধি নিষেধ গত ১ জুলাই শুরু হলেও গাজীপুরে কঠোর বিধি নিষেধ শুরু হয়েছিল তারও আগে গত ২১ জুন থেকে। দেশে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এর করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য গাজীপুরসহ ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় প্রথম কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় ২১শে জুন। এই বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার পর গত বুধবার মধ্যরাতে বিধি নিষেধ শিথিল করার আগ পর্যন্ত গত ২৪ দিনে গাজীপুরে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এই ২৪ দিনের কঠোর বিধি নিষেধ গাজীপুরে করোনা সংক্রমনের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি।
গাজীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২১ জুন থেকে গত বুধবার (১৪ জুলাই) মধ্যরাতে কঠোর বিধি-নিষেধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত জেলায় মোট করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৭৫৮ জন। তাদের মধ্যে মোট মৃত্যবরণ করেছেন ২৭৭ জন। অপরদিকে, লকডাউনের গত ২৪ দিনে গাজীপুরে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮২১ জন। এই সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৫০ জন। অর্থাৎ বিধি নিষেদের মাঝেই শনাক্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। গত বুধবার (১৪ জুলাই) জেলায় ৫১৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৫৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শনাক্তের হার ৪৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: মোঃ হাফিজ উল্লাহ জানান, তাজউদ্দীন মেডিকেলে ১০০ শয্যার করোনা ইউনিট রয়েছে। এ হাসপাতালের নিজস্ব ৬ হাজার লিটার অক্সিজেন প্লান্ট রয়েছে। প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য মাত্র ৪০৮টি অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ আছে। এ মজুদ দিয়ে একশর বেশী রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সারাদেশের করোনা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে অক্সিজেন বিভিন্ন হাসপাতালে রেশনিং পদ্ধতিতে লিকুইড অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে ৬ হাজার লিটার অক্সিজেন প্লান্ট এর জন্য ৫ হাজার ৪শ লিটার লিকুইড পাওয়া যেত, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এখন ২ হাজার ৬শ থেকে ২ হাজার ৭শ লিটার অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ৪০৮টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজের বর্তমান রোগীদের সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ ঘন্টা অক্সিজেন ব্যাকআপ দেয়া সম্ভব। অপরদিকে তাজউদ্দীন মেডিকেলের একশ শয্যার বিপরীতে গত বুধবার (১৪ জুলাই) রাত পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী ১১০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতাল থেকে ৫ জন রোগী রিলিজ হলে ২০ জন ভর্তি হয়।
তিনি আরো জানান, করোনা আক্রান্ত মানুষের সেবায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে অক্সিজেন। আমার এখানে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ না থাকলে রোগী বেশি ভর্তি করে কোন লাভ হবে না। এই হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার জন্য শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করার আগে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তা না করে এখানে শয্যা বাড়িয়ে কোন সুফল পাওয়া যাবে না।
হাসপাতালের পরিচালক আরো বলেন, যানজট পরিস্থিতির কারণে করোনা চিকিৎসায় মারাত্বক প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আশংকা রয়েছে। কারণ যানজটের কারণে জটিল কোন রোগীকে ঢাকায় পাঠানোর ক্ষেত্রে এবং জরুরী প্রয়োজনে ঢাকা থেকে লিকুইড অক্সিজেন এই হাসপাতালে আনা ও গ্যাস সিলিন্ডার রিফিল করতে পাঠানো এবং সেগুলো রিফিল করার পর পুনরায় হাসপাতালে ফেরত আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে ঈদ এবং বিধি-নিষেধ শিথিল করে গণপরিবহন চালু করা হয়েছে। ফলে মহাসড়কে এখন যানজট সৃষ্টির শংকা আছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, রোগীর চাপের কথা বিবেচনা করে আমরা আরও একটি ছয় হাজার লিটার অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাব করেছি। যাতে এখানে অক্সিজেনের কোন সংকট তৈরী না হয়। অব্যাহত রোগীর চাপ, তাজউদ্দীন হাসপাতালের সীমাবদ্ধতা, যানজট এবং রোগীদের কার্যকর চিকিৎসা প্রদানের সুবিধার জন্য গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে করোনা ইউনিট চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই হাসপাতালটি রাজধানী থেকে কাছে, ফলে জটিল রোগী ঢাকায় স্থানান্তর এবং জরুরী প্রয়োজনে উক্ত হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করা সহজ হবে। তাছাড়া সেখানে করোনা ইউনিট চালু হলে তাজউদ্দীন মেডিকেল এর উপর রোগীর চাপ কিছুটা কমে যাবে। এসময় তিনি অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করার সময় সম্পূর্ণ ভরে দেয়ার অনুরোধ করেন।
আলোনচনায় বিধিনিষেধের মধ্যে গাজীপুরে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়। এর জবাবে জেলা প্রশাসক জানান, গাজীপুর শিল্প অধ্যুষিত এলাকা। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এসব শিল্প কারখানা বন্ধ করাও সম্ভব হচ্ছে না। আবার জেলার শিল্প-কলকারখানা চালু রেখে, ৩০ লাখ শ্রমিককে বাইরে রেখে কোনোভাবেই কঠোর বিধি-নিষেধ অথবা লকডাউন দিয়ে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। টিকা পাওয়া গেলে শিল্প কলকারখানা চালু রাখার সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রমিকদের গণ টিকা প্রদান করার প্রস্তাব করেন তিনি। এসময় জানানো হয়, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে একেকটি শিল্প-কারখানায় আলাদাভাবে সমস্ত শ্রমিককে টিকা প্রদান করার বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।