গণবাণী ডট কম:
বিনা অপরাধে ৫ বছর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেয়েছেন নির্দোষ মো: আরমান। মাদক মামলায় দন্ডিত এক আসামীর পিতার নামের সাথে আরমানের পিতার নামের মিল থাকায় আরমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপরেই আরমানের জীবন থেকে চুরি হয়ে যায় মুল্যবান ৫টি বছর।
মো” আরমান (৪৬), রাজধানীর পল্লবীর ১০ নম্বর সেকশনের ব্লক-এ এর ১৩ হাটস’র মৃত ইয়াসিনের ছেলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মো: আরমান রাজধানীর পল্লবী এলাকার বেনারসী কারিগর। স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তান এবং মাকে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সকালে আরমান বাসায় নাস্তা করে রাজধানীর পল্লবীর ব্লক-এ, সেকশন ১০ নম্বর এলাকায় চা পানের জন্য পাশের একটি চায়ের দোকানে যান। এসময় সেখানে ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালায় পল্লবী থানা পুলিশ। এ অভিযানে ছিলেন তৎকালীন পল্লবী থানার এসআই রাসেল (বর্তমানে মিরপুর মডেল থানায় কর্মরত)। অভিযানকারীরা সেখানে আরমানকে দন্ডিত শাহাবুদ্দিন বিহারী হিসাবে গ্রেফতার করে। কারণ আরমানের পিতার নাম ও দন্ডিত শাহাবুদ্দিন বিহারির পিতার নামের মিল রয়েছে, তাই তিনি আরমান নন, তিনি শাহাবুদ্দিন বিহারী। তারপর থেকে আরমান নির্দোষ হয়েও শাহাবুদ্দিন বিহারী হিসাবে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ বন্দি জীবন যাপন করেছেন। কারাগারে থাকার সময়েই তার অন্ত:স্বত্বা স্ত্রী আরো এক পুত্র সন্তানের জন্মদেন। পুত্রের নাম রাখায় হয় ইমন। কিন্তু পিতা পুত্র কেউ কাউকে দেখার সুযোগ পাননি। কারাগার থেকে মুক্তির পর যখন তিনি পুত্র সন্তানের মুখ প্রথমবার দেখেন, তখন পুত্রের বয়স ৫ বছর। তিনি বুঝতে পারেন তার জীবন থেকে ৫ টি বছর চুরি হয়ে গেছে।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার -২ এর জেল সুপার আব্দুল জলিল জানান, আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লবের এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ আরমানকে মুক্তি দেয়াসহ তাকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে সংশ্লিষ্টদের আদেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশে বৃহস্পতিবার দুপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তিলাভ করেন।
আরমানের মুক্তিলাভের খবরে সকাল থেকেই অদেখা বাবাকে প্রথমবার দেখার জন্য কারাগারের মুল ফটকে ফুল নিয়ে অপেক্ষা করে আরমানের পুত্র ইমন। সাথে ছিল ইমনের বড় বোন, মা ও দাদীসহ স্বজনরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কারাগার থেকে বের হয়ে আসলে আরমানের স্ত্রী, দুই সন্তান ও স্বজনরা ফুল দিয়ে তাকে বরণ করে নেন। এসময় স্বজনরা আরমানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ককটেল ও দেশীয় অস্ত্রসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলায় গ্রেফতার আসামিদের দেওয়া তথ্য মতে, তাদের সহযোগীদের ধরতে ডিবির এসআই নূরে আলম সিদ্দিকী রাজধানীর পল্লবী এলাকার বিহারী ক্যাম্পের এক বাসায় অভিযান চালিয়ে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ শাহাবুদ্দিন বিহারি ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে। পরে এ ঘটনায় পল্লবী থানায় মামলা হয় মাদক দ্রব্য আইনে। পরে ২০০৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শাহাবুদ্দিনসহ গ্রেফতার তিন জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু ২০০৭ সালের ৫ মার্চ জামিনে মুক্ত হন শাহাবুদ্দিন বিহারি।তারপর থেকে তিনি পলাতক।
২০১২ সালের ১অক্টোবর মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফারুক আহমেদ। বিচারের রায়ে শাহাবুদ্দিন বিহারী ও তার দুই সহযোগীর প্রত্যেককে ১০ বছরের জেল ও ৫ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেন। এরপর পলাতক শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
রায় ঘোষণার ৪ বছর পর ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সকালে পল্লবীর ব্লক-এ, সেকশন ১০ নম্বর এলাকায় অভিযান চালায় পল্লবী থানার পুলিশ। এ অভিযানে সময় শাহাবুদ্দিনের বাবার নামের সাথে মিল থাকায় আরমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারপর বেনারসি কারিগর মো: আরমান হয়ে যান শাহাবুদ্দিন বিহারী। প্রকৃত আসামি শাহাবুদ্দিন বিহারি থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে আর নির্দোষ হয়েও ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে ৫ বছর কারাভোগ করেছেন আরমান।