গণবাণী ডট কম:
খামার মালিককে ফাঁকি দিয়ে বাজারে দুধ বিক্রীর টাকা থেকে প্রতিদিন ১০০/১৫০ টাকা চুরি করতেন ইয়াসিন। এ ঘটনা জানতে পেরে উক্ত টাকায় ভাগ বসাতে চায় রিয়াজ উদ্দিন। আর এ কারণে বিলের পানিতে ফেলে মাখায় আঘাত করে খুন করা হয় রিয়াজ উদ্দিনকে। খুনের পর ঘটনা ধামাচাপা দিতে পানিতে ডুবে যাওয়ার নাটক সাজিয়ে চিকিৎসার জন্য খুনিরাই লাশ নিয়ে যায় হাসপাতালে। ঘটনার প্রায় দুই বছর পর গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন ফুলদী সাকিনস্থ বিলের মধ্যে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর ছাইফ এগ্রোফার্মের কর্মচারী রিয়াজ উদ্দিন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন ও আসামী গ্রেফতার করল পিবিআই গাজীপুর।
গ্রেফতারকৃত আসামীরা হলো, নরসিংদী জেলার সদর থানার বেগম,সাং-দক্ষিন পুরানপাড়া এলাকার পিতা-মোঃ ফাইজ উদ্দিন মিয়া ছেলে মোঃ আজিজুল হক (২০), একই এলাকার পিতা-মোঃ হিরু মিয়া @ ভাসানীর ছেলে ইয়াছিন মিয়া (৩৯) ও একই জেলার শিবপুর থানার সৈয়দনগরের মোঃ সফিকুল ইসলামের শিশু পুত্র মোঃ আবির (১৬)।
নিহতের নাম রিয়াজ উদ্দিন (৩৫)। তিনি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার উদ্দিন,সাং-জামালপুর (হাজীপাড়া) এলাকার মোঃ নাজিমের ছেলে।
হত্যার শিকার রিয়াজ উদ্দিন ও গ্রেফতার আসামীরা সকলে গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানাধীন ফুলদি সাকিনস্থ ছাইফ এগ্রোফার্মের রাখাল হিসেবে কাজ করত। তাদের মধ্যে নিহতের বাড়ী গাজীপুর এবং হত্যাকারী সকলের বাড়ী নরসিংদী জেলায়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বুধবার দুপুরে এসব তথ্য জানান।
তিনি আরো জানান, গাজীপুর কালিগঞ্জ থানাধীন ফুলদি সাকিনস্থ ছাইফ এগ্রোফার্মের রাখাল রিয়াজ উদ্দিন ২০২০ সালের ২৮ জুন বিকালে উক্ত ফার্ম সংলগ্ন বিল থেকে হাঁস আনতে গিয়ে সাঁতার কাটা অবস্থায় পানিতে ডুবে যায়। পানি থেকে সহকর্মীরা ভিকটিমকে উদ্ধার করে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক রিয়াজ উদ্দিনকে মৃত্যু ঘোষনা করেন। এ সংক্রান্তে কালিগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। পরে ময়না তদন্ত শেষে চিকিৎসকগণ ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, মাথায় আঘাতের কারণে রিয়াজ উদ্দিন মারা যায়। পরবর্তীতে ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনের পিতা মোঃ নাজিম উদ্দিন অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কালিগঞ্জ থানা পুলিশ হত্যা মামলাটি ৩ মাস তদন্ত করে চুড়ান্ত রিপোর্ট বিজ্ঞ আদালতে দায়ের করলে বিজ্ঞ আদালত স্বপ্রনোদিত হয়ে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই গাজীপুর জেলাকে নির্দেশ প্রদান করেন।পরে অ্যাডিশনাল আইজিপি পিবিআই বনজ কুমার মজুমদারের তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় পিবিআই গাজীপুর ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমানের সার্বিক সহযোগীতায় মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) মোঃ জামাল উদ্দিন মামলাটি তদন্ত করেন।
তিনি আরো জানান, তদন্তকালে পিবিআই গাজীপুরের একটি টিম গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভিযান পরিচালনা করে মামলার ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামী মোঃ আজিজুল হককে গত ৬ জুন রাতে গাজীপুর জেলা কালীগঞ্জ থানাধীন ফুলদী এলাকা থেকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার স্বীকারোক্তি মতে একই তারিখ দিবাগত রাতে নরসিংদী সদর থানাধীন দক্ষিন পুরান পাড়া এলাকা হতে ঘটনার মূল আসামী ইয়াছিন মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গ্রেফতারকৃত উভয় আসামীর স্বীকারোক্তি মোতাবেক ঘটনার সাথে জড়িত আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশু মোঃ আবিরকে নরসিংদী কেশিবপুর থানাধীন সৈয়দ নগর এলাকা থেকে ৭ জুন ভোরে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত আসামীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ ইয়াসিন মিয়া, মোঃ আজিজুল হক ও মোঃ আবিরসহ ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিন কালিগঞ্জ থানাধীন ফুলদী সাকিনস্থ ছাইফ এগ্রোফার্মে রাখাল হিসেবে কাজ করত। তাদের মধ্যে আসামী
মোঃ ইয়াসিন মিয়া উক্ত ফার্মে দুধ বিক্রি থেকে শুরু করে ফার্মের যাবতীয় কাজ করত। আসামী মোঃ ইয়াসিন মিয়া দুধ বিক্রি থেকে শুরু করে ফার্মের যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশুনার দায়িত্বে ছিল। মোঃ ইয়াছিন আলী প্রতিদিন ফুলদী বাজারে ছাইফ এগ্রোফার্মের দুধ বিক্রি করত। আসামী মোঃ ইয়াসিন মিয়া দুধ বিক্রির টাকা থেকে প্রতিদিন ১০০/১৫০ টাকা গোপনে রেখে দিত। আসামী মোঃ ইয়াসিন একদিন ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনকে নিয়ে দুধ বিক্রি করতে গেলে রিয়াজ উদ্দিন টাকা রাখার বিষয়টি জেনে যায়। তারপর থেকে রিয়াজ উদ্দিন আসামী মোঃ ইয়াসিন মিয়ার চুরি কৃত টাকার অর্ধেক ভাগ চায়। টাকার ভাগ না দিলে রিয়াজ উদ্দিন ফার্মের মালিককে জানিয়ে দিবে বলে ইয়াসিন মিয়াকে হুমকি দেয়। ঘটনার অনুমান ২ দিন আগে এ নিয়ে রিয়াজ এর সাথে ইয়াসিনের ঝগড়া হয়। ঘটনার দিন দুপুরে গোসল করার সময় গ্রেফতারকৃত আসামীগন ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। তাদের পূর্ব পরিকল্পনা মতে ঘটনার দিন গত ২০২০ সালের ২৮ জুন বিকালে আসামী মোঃ ইয়াসিন মিয়াসহ অন্যান্য আসামীগন ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনকে সাথে নিয়ে বিলের মধ্যে হাঁস আনার জন্য যায়। অন্য দুইজন আসামী বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয়। কিছুদুর যাওয়ার পর আসামী মোঃ ইয়াসিন মিয়ার হাতে থাকা কাঠের লাঠি দিয়ে ভিকটিমের মাথায় ৩/৪ টা বারি মারে ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিন পানিতে ডুবে যায়। ইয়াসিন তার সহযোগী মোঃ আজিজুল ও মোঃ আবিরের কাছে ফিরে এসে তারা ৩ জন ফার্মে থাকা সিকিউরিটি গার্ড ও অন্যান্য লোকদের কাছে প্রচার করে যে রিয়াজ উদ্দিন পানিতে ডুবে গিয়াছে। পরবর্তীতে ঘটনায় জড়িত আসামী ইয়াসিন মিয়া ও অন্যান্য লোকজন বিলের পানিতে গিয়া ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনকে বিলের মধ্যে পানির নিচে হতে উদ্ধার করে। আসামী ইয়াসিন মিয়া ও আজিজুল হক কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার রিয়াজ উদ্দিনকে মৃত্যু ঘোষনা করেন।
এ বিষয়ে পিবিআই এর পুলিশ সুপার জনাব মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার জামালপুরে। সে পার্শ্ববর্তী ফুলদি এলাকায় ছাইফ এগ্রোফার্মে রাখাল হিসেবে কাজ করতো। ঘটনায় জড়িত আসামী ইয়াসিন মিয়া সহ অপর আসামীদের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। তারাও একই ফার্মে রাখাল হিসেবে কাজ করত। আসামী ইয়াসিন মিয়া উক্ত ফার্মে দুধ বিক্রয় সহ যাবতীয় কাজ দেখা শুনা করত। দুধ বিক্রয় করে প্রতিদিন কিছু টাকা আসামী ইয়াসিন চুরি করত। ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিন বিষয়টি জানতে পেরে মালিক পক্ষকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দিলে আসামীরা ভিকটিককে হত্যার পরিকল্পনা করে। ঘটনার দিন ২০২০ সালের ২৮ জুন বিকালে ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনকে সুকৌশলে ফার্ম সংলগ্ন বিলের মধ্যে হতে হাঁস আনার জন্য ড্রাম নিয়ে সাঁতার দিয়ে অনুমান ২০০ গজ যাওয়ার পর আসামী ইয়াসিনের হাতে থাকা কাঠের লাঠি দিয়ে রিয়াজ উদ্দিনের মাথায় ৩/৪ টি বারি দিলে রিয়াজ উদ্দিন পানিতে ডুবে যায়। তখন ইয়াসিন ফার্ম সংলগ্ন বিলের পাড়ে দাঁড়ানো অপেক্ষমান তার সহযোগীদের কাছে ফিরে এসে রিয়াজ উদ্দিন পানিতে ডুবে গেছে বলে প্রচার করে। ইয়াসিন পুনরায় ফার্মের সিকিউরিটি গার্ড ও কাঠ মিস্ত্রি নিয়ে পানির মধ্যে হতে রিয়াজ উদ্দিনকে উদ্ধার করে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসকগন রিয়াজ উদ্দিনকে মৃত্যু ঘোষনা করেন। মূলত প্রতিদিন দুধ বিক্রির টাকা হতে টাকা চুরি করার বিষয়টি জানতে পেরে উক্ত টাকার ভাগ চাওয়ায় ভিকটিম রিয়াজ উদ্দিনকে হত্যা করে হত্যাকারীরা পানিতে ডুবে রিয়াজ উদ্দিন মারা গেছে বলে প্রচার করে।
আসামী মোঃ ইয়াছিন মিয়া, মোঃ আজিজুল হক ও আবিরগনকে গ্রেফতার পূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৭ জুন বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে উক্ত আসামীগন নিজেদেরকে রিয়াজ উদ্দিন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িয়ে এবং ঘটনার সাথে জড়িত অপর আসামীদের নাম উল্লেখ করে এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে পরিকল্পনা এবং অন্যান্য আসামীদের কার কি ভূমিকা ছিল বিস্তারিত বর্ণনা করে বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে।