গণবাণী ডট কম:
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গাজীপুরের ৫টি সংসদীয় আসনের নৌকার মাঝির নাম ঘোষণা করে রোববার। গাজীপুর-৩ ছাড়া বাকী আসনগুলোতে বর্তমান সংসদ সদস্যগণই পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। নাম ঘোষণার একদিন পর সোমবার সন্ধ্যায় জেলার ৫টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৪টি আসনে স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীরা। এ ৪টি আসন হলো গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর উপজেলা ও গাজীপুর মহানগরীর ১-১৮টি ওয়ার্ড), গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর উপজেলা ও সদর উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন), গাজীপুর-৪ কাপাসিয়া ও গাজীপুর-৫ সংসদীয় আসন। এ নিয়ে জেলা সর্বত্র চলছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-১, গাজীপুর-৩, গাজীপুর-৪ এবং গাজীপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি, এমন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা, বর্তমান সংসদ সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রিটার্ণিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তারা বিধি অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিতে ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। এছাড়া গাজীপুর-৩ আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান সংসদ সদস্য ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ এবং গাজীপুর-৫ আসনে সাবেক এমপি আক্তারুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে নিজেরাই নিশ্চিত করেছেন।
তবে, ভবিষ্যতে কেন্দ্র যদি সিদ্ধান্ত বদল করে তবে, তাদেরও সিদ্ধান্ত বদল হতে পারে।
গাজীপুর-১ আসনে নবীন ও প্রবীনের লড়াই:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-১ সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম মোজাম্মেল হক আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধীতা করবেন। তিনি গাজীপুরের সবচেয়ে প্রবীন ও বায়োজৈষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা। এ আসনে তার প্রতিদ্বন্ধী হিসাবে নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চলেছেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল, গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আসনান সরকার রাসেল।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও রিটার্ণিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণার একদিনের মাথায় সোমবার গাজীপুর-১ আসন থেকে মোট ছয় জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত কামরুল আহসান সরকার রাসেলও রয়েছেন। এছাড়াও রেজাউল করিম রাসেল মনোনয়ন জমা দেয়ার জন্য ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন।
এরা তিনজনই বিভিন্ন সময়ে দলীয় প্রার্থী হিসেবে এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে অন্তত দুইজন দলীয় প্রার্থী স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) হিসেবে প্রার্থী হতে চলেছেন।
রেজাউল করিম রাসেল বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে মতবিনিময় সভায় দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোন নিষেধ করেননি বরং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে কোন প্রার্থী নির্বাচিত না হন তার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনটি যাতে অংশগ্রহণমূলক এবং ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে আসতে উৎসাহ বোধ করেন, সে জন্য আমি এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিব। এজন্য আমি ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছি।
গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আসনান সরকার রাসেল বলেন, রিটার্ণিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছি। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করছি। তারপর মনোনয়ন জমা দিব কি না সিদ্ধান্ত নিব।
গাজীপুর-১ আসনের অপর মনোনয়ণ সংগ্রহকারীরা হলেন, গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী, বিএনপি নেতা তানভির আহমেদ সিদ্দীকির ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ তরিকুল ফেডারেশনের প্রার্থী মোঃ শফিকুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ নূরে আলম সিদ্দিকী।
গাজীপুর-৩ আসনে দুই এমপির লড়াই:
গাজীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলীর কন্যা বর্তমান সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য রুমানা আলী ও তার ভাই জামিল হাসান দুর্জয়সহ অন্যরা। আওয়ামী লীগের মনোনয় লাভ করেছেন রুমানা আলী। দলীয় মনোনয়ন লাভের পর সোমবার রুমানা আলী শ্রীপুরে বড় ধরণের শো ডাউন করেন এবং সোমবার রিটার্ণিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তার মনোননয় ফরম সংগ্রহ করা হয়।
সোমবার সন্ধ্যায় গাজীপুর-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন ইকবাল হোসেন সবুজ। তিনি জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আামার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোন বাধা নেই। যদি নির্বাচিত হতে পার তাতেও কোন সমস্যা নেই। একারণে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবো। তিনি বলেন, বিগত ৫ বছর আমি এলাকার মানুষের সাথে থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করেছি। তারা নিশ্চয়ই আমার সাথে থাকবে। এ আসন থেকে আরো যারা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন, তারা হলেন, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের জেলা কমিটির সভাপতি আব্দুর রহমান, জাসদের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল হক মন্ডল বাচ্চু, স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের প্রার্থী রুমানা আলীর সহোদর ভাই) মো: জামিল হাসান এবং জাকের পার্টির প্রার্থী মো. আলাউদ্দিন রহমান। এ আসনে দুই এমপির তীব্র লড়াই হবে।
গাজীপুর-৪ আসনে মামাতো-ফুফাত ভাই বোনের লড়াই (?):
গাজীপুর-৪ আসনে আগে থেকেই তাজউদ্দিন পরিবারের দুই সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হবার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এরা হলেন, তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা ও বর্তমান সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার সিমিন হোসেন (রিমি) ও তাজউদ্দীন আহমদের ভাগিনা, বিশিষ্ট শিল্পপতি, বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা আলম আহমেদ। তারা উভয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সিমিন হোসেন (রিমি) কেই নৌকার মাঝি হিসেবে বাছাই করে নিয়েছে। তবে, এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চলেছেন রিমির মামাতো ভাই আলম আহমেদ। সোমবার রিটার্ণিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে সিমিন হোসেন (রিমি) ও আলম আহমেদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। আলম আহমেদ যদি মনোনয়ন ফরম জমা দেন তাহলে এখানে মামাতো ফুফাতো ভাই বোনের নির্বাচনী লড়াই হবে।
এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও আলম আহমেদকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে, তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, আলম আহমেদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন। তারা মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের শর্ত অনুযায়ী ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। নির্ধারিত সময়েই তারা রিটার্ণিং কর্মকর্তার নিকট মনোনয়ন ফরম জমা দিবেন।
গাজীপুর-৪ আসনের অপর মনোনয়ণ সংগ্রহকারীরা হলেন, জাকের পার্টি প্রার্থী জুয়েল কবির ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সামসুল হক।
গাজীপুর-৫ আসনে বর্তমান ও সা্বেক এমপির লড়াই:
গাজীপুর-৫ আসনের নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলা (পৌরসভাসহ) এলাকা এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড নাম্বার ৪০, ৪১, ৪২ এবং গাজীপুর সদর উপজেলাধীন বাড়িয়া ইউনিয়ন এলাকা নিয়ে গঠিত। এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য, সাবেক মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি, এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতার উজ্জামান। দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন মেহের আফরোজ চুমকি।
সোমবার রাতে এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মনোনয়ন বঞ্চিত আখতার উজ্জামান। তিনি বলেন, নেত্রীর নির্দেশে আমি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবো। নির্বাচন যাতে উৎসব মূখর হয়, মানুষ যাতে ভোট দিতে আসে এবং কালীগঞ্জ বাসীকে আরো বেশী ভালো সেবা দেওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে আমি নির্বাচনে অংশ নিব। এ আসন থেকে আরো মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টির প্রার্থী উর্মি, গণফোরাম প্রার্থী মো. সোহেল মিয়া এবং ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের প্রার্থী মো. আল আমিন দেওয়ান। এ আসনেও বর্তমান ও সাবেক এমপির লড়াই জমবে।
গাজীপুর-২ আসন সহজ সমীকরণ:
গাজীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, বর্তমান সংসদ সদস্য, ভাওয়াল বীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের সুযোগ্য উত্তরসুরী আলহাজ্ব মো: জাহিদ আহসান রাসেল। এখানে আলোচিত কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে সোমবার পর্যন্ত প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার কোন খবর পাওয়া যায়নি।
রিটার্ণিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী সোমবার পর্যন্ত এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. জয়নাল আবেদীন, গাজীপুর মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মো: সাইফুল ইসলাম এবং জাকের পার্টির প্রার্থী রিনা রহমান মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
তবে, রিটার্ণিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী সোমবার পর্যন্ত গাজীপুরের ৫টি আসনের কোন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেননি।