গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীর কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের তীরে বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার বিদেশি মেহমান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লাখ লাখ মুসুল্লীর অংশ গ্রহণে শুরু হয়েছে এবারের ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা। ইজতেমার মূল বয়ান মঞ্চ থেকে জ্যৈষ্ঠ মুরুব্বিরা আগত মুসুল্লিদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভাষায় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত ইসলামী বিধানের উপর দিক নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করছেন।
ইজতেমার প্রথম দিনে ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম জুমার নামাজের জামাত। জুমার নামাজের সময় ইজতেমা ময়দানের ১৬০ একর জায়গা ছাপিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কামারপড়া রোড, তুরাগের দুই পাড়, বাসাবাড়ির ছাদসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জুমার জামাতের মুসুল্লিদের অংশ গ্রহণে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এ নামাজে দেশের লাখ লাখ মুসুল্লি ছাড়াও ৪৭ টি দেশের প্রায় ১ হাজার ৭শতাধিক অংশ নেন। নামাজ শেষে ইজতেমায় আগত মুসুল্লিরা ময়দানে অবস্থান নেন। আশপাশ থেকে আসা মুসুল্লিরা পায়ে হেঁটে ময়দান থেকে চলে যান৷ অতিরিক্ত মানুষের চাপের ফলে পুরো এলাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়ক মাওলানা হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, জুমার নামাজের প্রায় ৪০ লাখ মুসুল্লির অংশ গ্রহণ করেছেন। মুসল্লীরা ইজতেমা ময়দানে জায়গা না পেয়ে ময়দানের চারপাশে সড়ক-মহাসড়ক ও বিভিন্ন গলিতে দাড়িয়ে নামাজে অংশ নিয়েছেন। অনেক মুসুল্লী ময়দানের পশ্চিমে তুরাগ নদের অপর পাড়েও নামাজে অংশ নিয়েছেন। একারণে জুমার নামাজের ইমাম বাংলাদেশের তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বী ও কাকরাইল মসজিদেরেইমাম মাওলানা যোবায়ের আহমেদ নদের পম্চিম তীরে গিয়ে নামাজের ইমামতি করেছেন।
ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুন নূর জানান, শুক্রবার বাদ ফজর ইজতেমার শীর্ষ মুরুব্বি পাকিস্তানের মাওলানা আহমদ বাটলার আম বয়ান করেন। এ সময় বাংলায় বয়ান তর্জমা করেন মাওলানা নুরুর রহমান। তিনি আরো জানান, বয়ানে বলা হয়েছে, নবীজী (সাঃ) কে আল্লাহ দুনিয়াতে আমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়েছেন। তিনি দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন,আমরাও দ্বীনের কাজ করবো। যতদিন দ্বীন থাকবে, তত দিন দুনিয়া থাকবে। আর দ্বীন টিকে থাকবে দাওয়াতের মাধ্যমে। ইজতেমায় আসার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ময়দান থেকে দ্বীনের শিক্ষা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়া। জান্নাত পেতে গেলে নবীজীর দেখানো পথেই চলতে হবে আমাদের। পরে সকাল ১০টায় ইমান ও আকিদার ওপর তালিম করেন মাওলানা জিয়াউল হক। জুমার পরে বয়ান করেন, জর্ডানের জিম্মাদার শেখ ওমর খতিব। তার বক্তব্য বাংলায় তর্জমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা জাকির। ইজতেমায় আসরের নামাজের পরে বয়ান করেন মাওলানা জুবায়ের। মাগরিবের নামাযের পরে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আহমেদ লাট। তার বক্তব্য বাংলায় তর্জমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক।
শুক্রবার সকাল থেকে ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দেশ বিদেশের লাখ লাখ মুসুল্লীর ঘন কুয়াশা ও শীত উপেক্ষা করে ময়দানের ৯৩টি খিত্তায় ভাগ হয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এর আগে তাঁরা গত বুধবার থেকে সকল বাধা ও শংকাকে পেছনে ফেলে বাস, ট্রাক, কার, পিকআপ ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে দলে দলে ইজতেমা ময়দানে আসেন। তাঁরা কাঁধে-পিঠে করে শীতের পোশাক, খাদ্য ও রান্নার সামগ্রী এবং প্রয়োজনীয় মালামাল সাথে নিয়ে এসছেন। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে ইজতেমা ময়দান। মুসুল্লীদের পদচারণায় ইজতেমা ময়দান ও তার আশপাশ এখন মুখরিত।
ইজতেমার মূল বয়ান মঞ্চ থেকে জ্যৈষ্ঠ মুরুব্বিরা আগত মুসুল্লিদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভাষায় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত ইসলামী বিধানের উপর দিক নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করছেন।
শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুর ও টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে জুমার নামাজে অংশ নিতে শুক্রবার সকাল থেকে সড়ক পথ, রেলপথ ও নৌপথসহ সব পথেই টঙ্গীর তুরাগ তীরে ঢল নামে মুসুল্লিদের। ময়দানে জায়গা না পেয়ে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে মুসুল্লিগণ আশপাশের সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নেন। এসময় মহাসড়কে অসংখ্য যাত্রীবাহি বাস ও ব্যক্তিগত যানবাহন আটকা পড়ে। হাজার হাজার মুসুল্লি সড়ক-মহাসড়কে নামাজের জন্য সাথে নিয়ে আসা কাগজ, পলিথিন, জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়েন। অনেকে সড়কে দাড়ানো বাসের ছাদে, আশপাশের বিভিন্ন ভবনের ছাদে দাড়িয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। এতে করে আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের টঙ্গী কলেজ গেট এলাকায় সড়ক পুরোপুরি মুসুল্লিদের দখলে চলে যায়। একারণে ঢাকা-ময়শনসিংহ মহাসড়কে দুপুর ২টা দীর্ঘ পর্যন্ত যানবাহন ঠায় দাড়িয়ে থাকে। এতে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট তৈরী হয়।
হারানো পাসপোর্ট ফিরে পেলেন বিদেশী মেহমান:
বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়ে আসা ভারত বংশদ্বোত কোরিয়ান নাগরিক সুলতান আহমেদ (৫৮) এর পাসপোর্ট হারানো যায়। পরে সেটি উদ্ধার করে দেয় পুলিশ।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে ময়দানের ভিতরে ওজু খানায় তার ব্যাগটি হারানো যায়। ব্যাগটিতে তার পাসপোর্ট, ইউএস ডলার, কোরিয়ান টাকাসহ মোট ৬০ হাজার টাকা, কোরিয়ান সিমযুক্ত মোবাইলসহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল।
তিনি আরো বলেণ, বিষয়টি জানার সাথে সাথে আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে ব্যাগটি উদ্ধারে কাজ শুরু করা হয়। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই পুলিশি তৎপরতায় খোয়া যাওয়া ব্যাগটি উদ্ধার করে ওই নাগরিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মুসুল্লির মৃত্যু :
এবারের ইজতেমায় শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত মোট ৪ মুসুল্লীর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, নেত্রকোনার বুরুজুরি স্বল্পদিঘীয়া গ্রামের এখলাস মিয়া (৭০)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার অরুয়াইল ইউনিয়নের ধামাউরা গ্রামের ইউনুস মিয়া (৬৭), চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলা চৌহদ্দীগ্রামের জামাল উদ্দিন (৭৪) ও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার আত্তার সাত্তার (৬৭)। তাদের জানাজার নামাজ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাদের স্বজনেরা মরদেহ নিজ নিজ গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যায়।
বিশ্ব ইজতেমায় পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু :
বিশ্ব ইজতেমার দায়িত্ব পালন করতে যাওয়ার পথে ময়দানের পাশেল ঢাতা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গীল মিল গেইট এলাকায় শুক্রবার ভোরে বাসের ধাক্কায় হাসান (৩২) নামে পুলিশের সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় অপর এক পুলিশ সদস্য উপ পরিদর্শক (এসআই) আমির হামজা (৩৩) গুরুতর আহত হয়েছেন।
ঘটনার পর তাদেরকে উদ্ধার করে টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৯টায় সহকারী উপপরিদর্শক হাসানের মৃত্যু হয় ।
টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, শুক্রবার সকালে মানিকগঞ্জ জেলার কন্ট্রোলরুমে কর্মরত (এসআই) আমির হামজা ও (এএসআই ) হাসান ইজতেমা ময়দানে দায়িত্ব পালনের জন্য একটি মোটরসাইকেল যোগে (ঢাকা মেট্রো-ল- ৬১-৪৩৬) ইজতেমা ময়দানে আসছিলেন। ভোর সোয়া ৬টার দিকে তাদের গাড়িটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গীর মিলগেইট এলাকায় পৌঁছলে গাজীপুর থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী একটি বলাকা পরিবহনের বাস তাদের সজোরে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে তারা উভয়েই মহাসড়কে ছিটকে পড়ে গুরতর আহত হন। পরে মহাসড়কে থাকা পথচারিরা তাদের উদ্ধার করে টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসক। সেখানে হাসানের মৃত্যু হয়। নিহত হাসান মানিকগঞ্জ জেলার কোর্টে কর্মরত ছিলেন।
ইজতেমার মুরুব্বীদের সংবাদ সম্মেলন:
শুক্রবার বিকাল ৩টায় জেলা প্রশাসকের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কেন্দ্রে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেছেন ইজতেমার প্রথম পর্বের আয়োজকদের শীর্ষ মুরুব্বী মুফতী আমানুল হক। এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মামুনুল করিম, ইজতেমার মিডিয়া বিষয়ক সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হানসহ অন্যরা।
মতবিনিময়কালে শীর্ষ মুরুব্বী মুফতী আমানুল হক ইজতেমা দুইভাবে বিভক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট ও কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
শীর্ষ মুরুব্বী মুফতী আমানুল হক বলেন, আমাদের আরজ আপনারা আমাদেরকে যোবায়ের অনুসারী/পন্থী না বলে আমাদের শুরায়ে নীজাম হিসাবে অভিহিত করবেন। তিনি বলেন, খোদা না করুন আজকে মাওলানা যোবায়ের সাহেব মারা গেলে আমাদের ইজতেমা থাকবে না? আমরা কোন ব্যক্তি নই। আমরা ১০/১২ জন মুরুব্বী নিজেদের মধ্যে মাসোয়ারা করে-সলাপরামর্শ করে তারিপরে যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। কারো একক সিদ্ধান্তে এখানে কিছু করা হয় না। এজন্য আমরা শুরায়ে নীজাম।
এসময় তিনি বলেন, কিন্তু মাওলানা সাদ এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে থাকেন। এসময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, মাওলানা সাদ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে এককভাবে কিছু মতামত দিয়েছেন, যে সব মতের সাথে বিশ্বের অন্য মাওলানাগণ একমত নন। তারা আমরা আলাদা হয়ে গেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি মাওলানা সাদ তার ভূল স্বীকার করেন, তাহলে আবার এক হতে কোন বাধা নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আল্লাহ সবাইকে সহীক বুঝ দান করবেন।
এসময় জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে উভয় পক্ষ সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি উভয় পক্ষ ধর্মীয় অনুসাসন মেনে শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমাকে সফল করবেন। এ লক্ষে আমরা সব রকম সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছি।