গণবাণী ডট কম:
রাজধানীর উপকন্ঠে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে শুরায়ে নিজামের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসুল্লী শনিবার দিনভর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের ইমান, আমল ও আখলাককে পরিপূর্ণ শুদ্ধরূপ দিতে তাবলীগের বিভিন্ন বিষয়ের বয়ান শুনে অতিবাহিত করেছেন। রোববার আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করবেন বলে জানান মুসল্লীরা।
আখেরি মোনাজাতের আগে হেদায়েতি বয়ান করা হবে। আশা করা হচ্ছে, তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বিদের পরামর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা যোবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন। আখেরি মোনাজাতে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নেবেন বলে আয়োজকদের ধারণা।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহবুব আলম জানিয়েছেন, আখেরি মোনাজাত রোববার সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জানান, শনিবার বিকালে ইজতেমার মুরুব্বিদের সঙ্গে কথা বলে ওই সময় জানতে পেরেছেন।
আয়োজকরা জানান, ২য় দিনে শুধুমাত্র তাবলীগ কর্মকান্ডের উপর আলোচনা এবং জোট বন্দি হয়ে তাবলীগের উপর আলোচনাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এবাদত বন্দিগী, খিত্তা ভিত্তিক তাসকিলে তামিল, ইস্তেকবাল জামাত, জুরনেওয়ালী জামাত, গঠন এরং চিল্লা বন্দি হওয়ার উপর আমল করা হয়। আখেরী মোনাজাতের পর এখান থেকে নতুন নতুন জামাত আগামী এক বছর দেশ বিদেশে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে যাবে।
শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, ইসলামী দাওয়াতের মাধ্যমে ঈমান আকিদা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে ইহলোকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল কামনা জন্য মুসুল্লীরা দেশের দূর দূরান্ত থেকে লাখ লাখ মুসুল্লী ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। ইজতেমাকে ঘিরে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীর পুরো শিল্প এলাকা এখন দাড়ি টুপী পরিহীত মুসুল্লীদের পদচারণায় পবিত্র ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। ইজতেমা শুরু আগে থেকেই ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা যেন জনসমুদ্র। ময়দানে অবস্থান নেয়া দেশী-বিদেশী লাখ লাখ মুসল্লি ছাড়াও আরো লাখ লাখ মুসুল্লী রোববার সকালে ইজমেতায় আসবেন আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে। রাজধানীসহ গাজীপুরের চারপাশের সকল জেলা থেকে বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনের গন্তব্য হবে ইজতেমার ময়দান। আখেরী মোনাজাতে অংশ নিয়ে রোববার ভোর থেকেই টঙ্গী মূখী মানুষের ঢল নামবে। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে।
আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা প্রস্তুতি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচলে বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। রেলওয়ে বিভাগ আখেরি মোনাজাতের অতিরিক্ত মুসল্লি সামলাতে টঙ্গি স্টেশনে অতিরিক্ত ট্রেন ও সকল ট্রেনের যাত্রাবিরতির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
ইজতেমা আয়োজক কমিটির গণমাধ্যম সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, শনিবার বাদ ফজর বয়ান করেছেন ভারতের মুম্বাইয়ের মাওলানা আব্দুর রহমান হাফি। তার বক্তব্য বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। বয়ানে বলা হয়,পরকালের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির জন্য আমাদের সবাইকে দুনিয়াতে জীবিত থাকা অবস্থায় দ্বীনের দাওয়াতের কাজে জানমাল দিয়ে মেহনত করতে হবে। ঈমান-আমলের মেহনত ছাড়া কেউ হাশরের ময়দানে কামিয়াব হতে পারবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের ঈমান (বিশ্বাস), আমল (কর্ম) ও আখলাককে (চরিত্র) পরিপূর্ণ শুদ্ধভাবে গড়ে তুলতে এই বয়ান শুনছেন ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা।
বয়ানে আরো বলা হয়, দাওয়াতের মেহনত হলো নবুওয়াতি মেহনত। এ মেহনত খুলুসিয়াত ও আজমতের সাথে যারা করবে তাদের যেকোন আমলের ফজিলত বহুগুণ বেড়ে যায়।
তিনি আরো জানান, বাদ যোহর বয়ান করেন ভারতের গোধরার মাওলানা ইসমাইল গোদরা। তার বক্তব্য বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। বাদ আছর ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাছান বয়ান করেন। তার বক্তব্য বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা জাকারিয়া।
তিনি আরো জানান,বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা বয়ান করেন।
যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা:
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, আমরা আখেরি মোনাজাতের জন্য নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে। আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে আগামীকাল ভোর রাত ৩টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এয়ারপোর্ট থেকে জয়দবেপুর চৌরাস্তা, ঢাকা-সিলেট সড়কের মীরের বাজার থেকে টঙ্গী ও আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়কের আব্দুল্লাহপুর থেকে বাইপাস সড়ক পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকবে মোনাজাত শেষ হওয়া পর্যন্ত। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ব্যবহারকারীগণ ড্রাইভার্ট হয়ে ভোগড়া বাইপাস দিয়ে মীরের বাজার হয়ে ঢাকা যাবেন। তবে ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীদের গাড়ি আসতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, ঢাকা মহানগর এলাকায় কুড়িল বিশ্বরোড থেকে ড্রাইভার্ট করে তিনশ ফিট হয়ে চলাচল করবে। আশুলিয়া সড়কের গাড়ি মিরপুর বেড়িবাঁধের দিক দিয়ে চলবে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, আখেরি মোনাজাত শেষ হলে চেষ্টা করা হবে, এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভারটি আগে চালু করার জন্য। ফ্লাইওভার চালু হলে আস্তে আস্তে যানবাহনগুলো ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঢুকতে পারবে।
ময়দানে এসেছেন হাজারো বিদেশি মুসল্লি:
ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, শনিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ৮৭টি দেশের ২ হাজার ৩০৪জন বিদেশি মুসল্লি ময়দানে এসেছেন। তাঁরা উত্তর-পশ্চিম দিকে নির্ধারিত বিদেশী খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। আখেরী মোনাজাতের আগে আরো বিদেশী সাথী ভাই ইজতেমায় অংশ নিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
যৌতুক বিহীন বিয়ে:
প্রতিবারের ন্যায় এবারেও ইজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করা হয়। আসর নামাজের পর ময়দানে বয়ান মঞ্চের পাশে হযরত ফাতেমা (রা.) ও হযরত আলী (রা.) এর বিয়ের দেনমোহর অনুসারে এ বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। এবার ময়দানে ৭২ জোড়া বর কনে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানটি ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাসান পরিচালনা করেন।
বিয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান।
তিনি আরো জানান, ওইসব বর-কনের অভিভাবকদের সম্মতিতে বিয়ে পড়ানো হয়। বিয়ে শেষে উপস্থিত দম্পতিদের স্বজন ও মুসল্লিদের মধ্যে খোরমা-খেজুর বিতরণ করা হয়।
মুসুল্লীর মৃত্যু :
বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সেলের প্রধান মো: হাবিবুল্লাহ রায়হান জানিয়েছেন,শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে শনিবার আছর পর্যন্ত ইজতেমার ময়দানে আরো ৫ মুসুল্লীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের নিয়ে ইজতেমায় আগত মোট ৯ মুসুল্লীর মৃত্যু হলো। তারা হলো, শেরপুর জেলা সদরের জুগনিবাগ গ্রামের মৃত সমশের আলীর ছেলে নওশের আলী (৬৫), ভোলা জেলার পরাগগঞ্জ থানার সামানদার গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ছেলে আ. কাদের (৫৫), নেত্রকোনা সদরের কালিয়াঝুড়ি এলাকার হোসেন আহম্মদের ছেলে স্বাধীন (৪৫)। এর আগে আরো মারা গেছেন, নেত্রকোনা থানার কুমারী বাজার গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে আবদুস সাত্তার (৭০),একই জেলার বুড়িঝুড়ি গ্রামের স্বল্পদুগিয়া গ্রামের আব্দুস ছোবাহানের ছেলে এখলাস মিয়া (৬৮), ভোলা জেলার ভোল্লা গ্রামের নজির আহমেদের ছেলে শাহ আলম (৬০), জামালপুর জেলার তুলশীপুর এলাকার পাকুল্লা গ্রামের হযরত আলীর ছেলে মতিউর রহমান (৬০)। অপর দুই জনের পরিচয় ——–
তিনি আরো জানান, ইজতেমার ময়দানে আসার পথে তিন জন মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা হলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার ধামাউরা গ্রামের ইউনুছ মিয়া (৬০), চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার চৌহদ্দীটোলা গ্রামের জামান মিয়া (৪০) ও ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করতে আসার পথে বাসচাপায় নিহত পুলিশ সদস্য হাসান উজ্জামান (৩০)।
রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্বের ইজতেমা। মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ৯ জানুয়ারি শুরু হবে ভারতের মাওলানা সাদ অনুসারীদের আয়োজনে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ১১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দুই পর্বের ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা।