গণবাণী ডট কম:
আত্মশুদ্ধি, পরম করুনাময় দয়ালু আল্লাহর রহমত লাভ, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ, আখিরাতের শান্তি কামনা ও ক্ষমার আকুতি জানিয়ে অশ্রুসিক্ত বদনে লাখ লাখ মুসুল্লীর অংশ গ্রহণে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রবিবার শেষ হলো মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় আয়োজন তাবলিগ জামাতের ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা। তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা শেষ পর্বের আয়োজন করলেও অনুমতি না থাকায় ইজতেমায় আসেননি তিনি। তার অনুপস্থিতিতে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন তাঁর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ। মোনাজাতে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনা করে অঝোরে কেঁদেছেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ। তার সাথে মোনাজাতে অংশ নেয়া লাখো মুসল্লিও অঝোরে কেঁদেছেন। এ সময় ময়দানে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত আমিন; ছুম্মা আমিন ও কান্নার ধ্বনিতে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম জানান, রোববার বেলা ১১টা ১৭ মিনিটে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শুরু করেন ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ। প্রায় ২৬ মিনিটের আখেরি মোনাজাত শেষ হয় ১১টা ৪৩ মিনিটে। তিনি জানান, মোনাজাতে মোনাজাতে বিশ্বের মুসলমানদের হেদায়েত, ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহকাল ও পরকালের নাজাত এবং দ্বীনের দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য দোয়া করা হয়। এছাড়া সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়।
বলা হয়, ‘ইয়া আল্লাহ পুরি ইনসানিয়াত কো হেফাজত ফরমা, ইয়া আল্লাহ পুরি উম্মত পর রহম ফরমা, ইয়া আল্লাহ তু হামপর রাজি হো যা, ইয়া আল্লাহ হামারে দিলকো ইসলাম পর কবুল ফরমা, ইয়া আল্লাহ ছব লোক কো হেদায়াত নসিব ফরমা, ইয়া আল্লাহ পেরেশানি কো দূর ফরমা, ইয়া আল্লাহ ইজতেমাকো কবুল ফরমা, ইয়া আল্লাহ ছব লোক কো মোনাজাত কবুল ফরমা।’ আরবী ও উর্দু ভাষায় পরিচালিত মোনাজাতে বিশ্বের সকল মুসলিমের হেফাজত, উম্মতে মুহাম্মদির মাগফিরাত, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ, নবী-রাসূল-সাহাবিদের সাথে হাশর নশর ও কায়মনোবাক্যে জান্নাত কামনা করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের উত্তরোত্তর উন্নতি, হেফাজত, মুসলিম জাহানের মজবুতী ইমান, দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা, সুন্নতী জিন্দিগী, মসজিদ আবাদ, মসজিদ ও দ্বীন ইসলামের হেফাজত, তাবলিগ জামাত ও ইজতেমাকে কবুলসহ দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবি, কল্যাণ কামনা এবং যাবতীয় আজাব-গজব, অকল্যাণ থেকে হেফাজত কামনা করা হয়।
ভাবাবেগপূর্ণ পরিবেশে ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে শীতের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মহামহিম ও দয়াময় আল্লাহর দরবারে অপার করুণা ও অশেষ রহমত কামনা করে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন ৬৫ দেশের ৯ হাজার ২৮৫ জন বিদেশী মেহমানসহ দেশের প্রায় ২০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
জানা গেছে, আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার রাত থেকেই গাড়িতে, হেঁটে, ট্রেনে ইজতেমায় হাজির হতে থাকেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষ। কিন্তু ইজতেমা ময়দান আগে থেকেই পরিপূর্ণ থাকায় তারা আশেপাশের সড়ক, ফুটপাথ ও বিভিন্ন বাড়ির ছাদে অবস্থান নিতে থাকেন। রোববার ভোর থেকে ঢাকা, আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের প্রত্যন্ত এলাকার মুসল্লিরা দলে দলে ইজতেমা অভিমুখে রওনা হন। সব পথের মোহনা হয়ে ওঠে তুরাগতীরের ইজতেমা ময়দান। টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান, অফিসসহ প্রায় সব কিছু ছিল বন্ধ। সবার প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের সঙ্গে মোনাজাতে শরিক হয়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। বিশাল জনসমুদ্র থেকে আকাশ কাঁপিয়ে ধ্বনি ওঠে-ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ। মুঠোফোনে এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের আরো লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তুলেছেন ক্ষমাশীল পরওয়ারদিগারের শাহী দরবারে। গুনাহগার, পাপী-তাপী বান্দা প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চেয়ে কান্নায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন।
ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী সায়েম জানান, বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিন রোববার ফজরের পরে হিন্দিতে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মুফতি মাকসুদ। তার বয়ান তাৎক্ষণিকভাবে বাংলায় তরজমা মাওলানা আব্দুল্লাহ। তার বয়ানের পরেই সকাল ১০টার দিকে হেদায়েতের বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা মনির বিন ইউসুফ।
তিনি আরো জানান, হেদায়েতের বয়ান শেষ হওয়ার পরে বাংলাদেশের সুরা ফয়সাল সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম এক মিনিট ১০ সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। তিনি বলেছেন, আজ যদি মাওলানা সাদ সাহেব এখানে আসতেন তাহলে এই দোয়া সে করতেন আমাদের এই পুরা মজমা এই ব্যথা দীলে রেখে এস্তেমা শেষ করলাম। আমরা সকলে খুব বেশি দোয়া করব যাতে মাওলানা সাদ সাহেব খুব দ্রুত বাংলাদেশে আসতে পারেন, তখন পুরো মজামাকে দোয়া করার জন্য ওয়াদা করান এবং যারা বিরোধিতা করে মাওলানা সাদ সাহেবের আসার বিষয় তাদের কেও মাওলানা সাদ সাহেব আসার বিষয় বাধা ও বিরোধিতা না করার আহ্বান জানান এবং সহযোগিতা করতে বলেন যাতে মাওলানা সাদ সাহেব আসতে পারে।
তার বক্তব্যের পরেই আখেরী মোনাজাত শুরু করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ।
আখেরি মোনাজাতে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, সাবেক সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম, জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এদিকে ইজতেমা ময়দানের চারদিকে বিভিন্ন অলিগলিতে রাস্তায় বসে নারীদেরকেও মোনাজাতে শরিক হতে দেখা গেছে। মোনাজাতে শরিক হতে বাদ পড়েনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুরুষ ও নারী সদস্যরাও। বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় যারা বসা ছিলেন তারাও যার যার জায়গা থেকে মোনাজাতে শরিক হন।
টঙ্গীর কামারপাড়া সড়কের মাথায় মোনাজাতে অংশ নিতে স্বামীর সঙ্গে ইজতেমা ময়দানে সন্তান নিয়ে এসেছেন আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, গতকাল শনিবার রাত ১১টায় ইজতেমা ময়দানে এসে সড়কের পাশে ডিভাইডারে অবস্থান নিয়েছেন। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে পেরে অনেক খুশি। তার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্ত্রীর খুব ইচ্ছা সে ইজতেমায় আসবে, আখেরি মোনাজাতে অংশ নেবে। তার ইচ্ছা পূরণ করতেই তাকে বিশ্ব ইজতেমা এসেছেন।
উল্লেখ্য, এবার শুরায়ে নিজামের আয়োজনে ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম পর্বে এবং ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাদ কান্ধলভির আয়োজনে দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। দুই পর্বে ১৯জন ও দ্বিতীয় পর্বে ৮ জনসহ ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমায় মোট ২৭ জন মুসুল্লী মারা গেছেন।
ফিরতি পথে ভোগান্তি: রোববার আখেরী মোনাজাত শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় ফিরতি যাত্রা। ময়দানের ভিতরে ও বাইরে ইজতেমায় অংশ নেয়া মুসুল্লীদের মধ্যে জামাত বন্ধি মুসুল্লীরা ব্যতিত অন্য মুসুল্লিরা নিজ নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে বাস, ট্রাক, কার, মাইক্রোবাস, রিক্সা, অটোরিক্সা, ভ্যানগাড়ী ও ট্রেনে চড়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। একারণে ময়দানের চারপাশের সকল সড়ক ও মহাসড়কে মানুষের চাপ বেড়ে যায়। একসাথে হাজার হাজার মানুষ কোন যান বাহন না পেয়ে পায়ে হেটে গন্তব্যের দিকে যাত্রা করেন। এসময় ভীড় ও যানজটের কারণে সবাইকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রীর তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় অনেক যানবাহনে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। কাধে সামানার বুঝা নিয়ে দীর্ঘ পথ হেটে যাওয়ার চেয়ে বাধ্য হয়ে বেশী ভাড়ায় গন্তব্যে রওয়ানা হয়েছেন অনেক যাত্রী।
এসব বিষয় নিয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন,প্রথম পর্বের ন্যায় দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় আগত মুসুল্লীদের সেবার জন্য জেলা প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন সংষ্থা মাঠ পরিস্কার, নিরাপত্তাসহ সকল বিষয়ে একসাথে কাজ করেছে। দুই পক্ষের ইজতেমার মুরুব্বী, অংশগ্রহণকারী মুসুল্লী সকলেই আমাদের কাছে সমান সুযোগ সুবিধা পেয়েছে। দুই পর্বের ইজতেমা অত্যন্ত শান্পিূর্ণভাবে শেষ হওয়ায় আমরা সন্তোষ্ট। এজন্য তিনি সকলকে ধন্যবাদ জানান।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম বলেন,ইজতেমায় আগত দেশী বিদেশী মুসুল্লীদের নিরাপত্তা, তাদের যাতায়াতের জন্য মহানগর পুলিশ প্রথম পর্বের ন্যায় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আখেরী মোনাজাতের শেষে একসাথে অসংখ্য মানুষ তাদের জিনিসপত্র নিয়ে সড়কে নেমে আসায় সাময়িক অসুবিধা হলেও পরে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। ইজতেমা অত্যন্ত সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। এজন্য সকল পক্ষকে তিনি ধন্যবাদ জানান।
শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমা আয়োজন সম্পন্ন হওয়ায় শুকরিয়া আদায় করেছেন বাংলাদেশের সুরা ফয়সাল সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম। তিনি ইজতেমা সফল করতে যারা মেহনত করছেন সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা - কর্মচারীদের ইজতেমায় সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানান।